শেখ হাসিনা দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হন ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে। তখন থেকে কয়েকটি কলামে লিখেছিলাম, গোড়া থেকেই তাঁর সরকার যেন জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করার জন্য পরিকল্পিতভাবে উঠেপড়ে লেগেছেন। যুক্তিতর্ক দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, জাতীয় ঐক্য ছাড়া দেশ ও জাতির উন্নতি সম্ভব নয়, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো সমস্যাসঙ্কুল দেশে। বিভিন্ন কলামে প্রাচীন ভারতবর্ষের সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের অমাত্য চাণক্যের কাহিনী বিবৃত করে আরো বলেছিলাম, সম্রাট কোনো রাজ্য দখল করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলে চাণক্য প্রথমে সে দেশে গোয়েন্দা পাঠাতেন। গোয়েন্দারা বিবাদ-বিসম্বাদ, ঝগড়াঝাঁটি ও দলাদলি সৃষ্টি করে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করত। সে রাজ্য তাতে দুর্বল হয়ে পড়ত এবং রাজ্যটি দখল করা চন্দ্রগুপ্তের সৈন্যদের জন্য সহজ হয়ে যেত।
আমি একাই সব কৃতিত্ব নেয়ার চেষ্টা করছি না। বাংলাদেশের বহু বিজ্ঞ ব্যক্তি এবং বেশ কয়েকজন কলামিস্ট ও সাংবাদিক মোটামুটি একই রকম পরামর্শ দিয়েছেন শেখ হাসিনাকে। কিন্তু কার কথা কে শোনে? শেখ হাসিনা হয় নিজেকে সব জ্ঞানবুদ্ধির আধার মনে করেন, নয়তো পরামর্শ বাইরে থেকে না এলে তার মনঃপূত হয় না। অন্য দিকে, শহীদ জিয়াউর রহমানের সাথে ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারির একটি একান্ত আলাপের কথা লিখে পাঠকদের বিরক্তি উৎপাদন করছি কি না, ভয় হয়। সে আলোচনায় তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল জিয়াউর রহমান দেশের বিদ্যমান সমস্যাগুলো শনাক্ত করে সমাধানের জন্য তার চিন্তাভাবনার উল্লেখ করছিলেন।
জেনারেল জিয়া বলেছিলেন, সেনাবাহিনীতে চেন অব কম্যান্ড ফিরিয়ে আনা তার একটা বড় ভাবনা। তিনি বলেছিলেন, তরুণদের, বিশেষ করে শিক্ষিত বেকারদের গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা না হলে ভয়াবহ সামাজিক সমস্যা ও অশান্তি দেখা দেবে। গণতন্ত্র বাংলাদেশের মানুষের রক্তে মিশে আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর সব বেসরকারি পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া এবং আওয়ামী লীগসহ সবগুলো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা দেশের মানুষের মনঃপূত হয়নি। জিয়া জানান, তিনি অবিলম্বে পত্রপত্রিকার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবেন। গণতান্ত্রিক রাজনীতি ফিরিয়ে আনার পন্থা সম্বন্ধে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপকসহ চিন্তাবিদদের সাথে আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন বলেও উল্লেখ করেন।
আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়নি এবং স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, তাদের কেন তিনি জাতীয় জীবনে পুনর্বাসনের সুযোগ দিচ্ছেন? জিয়া চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন। বললেনÑ দেখুন, এরা তো এ দেশেরই লোক, আর কোন দেশ তাদের নেবে, আপনিই বলুন। একটু হেসে তিনি বলেন, আপনি তো বিলেতে থাকেন, সে দেশের সরকারকে বলে দেখুন না, তারা এদের নেবে কি না। আর যদি কেউ না নেয় তাহলে এদের নিয়ে আমি কী করব, বলুন? আমি কি তাদের বঙ্গোপসাগরে ফেলে দিয়ে আসব? তাদের যদি জাতীয় জীবনে সম্পৃক্ত না করি, তাহলে সব সময় আমাকে পিঠের দিকে চোখ রাখতে হবে, ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে কখন কে ছুরি মারে। সব সময় যদি পিঠ বাঁচানোর চিন্তায় ব্যস্ত থাকি, তাহলে দেশের হাজারো সমস্যা সমাধানের চিন্তা করব কখন?
বাংলাদেশের বর্তমান সরকার মরহুম শেখ মুজিবকে সম্ভবত দেবতাদের চাইতেও উঁচুতে স্থাপন করতে চায়। কিন্তু শেখ মুজিব যা বুঝেছিলেন, সেটা বুঝতেও তারা রাজি নন। একাত্তরে এবং পরবর্তী বছরগুলোতে সংশ্লিষ্ট খবরগুলো বিবিসি থেকে প্রচার করা এবং বিশ্বমিডিয়াকে বোঝানো আমার কাজ ছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একাত্তরে যে নৃশংসতা দেখিয়েছে, তার দৃষ্টান্ত বিশ্বের ইতিহাসে খুব বেশি নেই। তাদের ভেতর ১৯৫ জন সেনাকে জঘন্যতম যুদ্ধাপরাধের দায়ে শনাক্ত করা হয়েছিল। শেখ হাসিনার পিতা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে শুধু যে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যকে মুক্তি দিয়েছেন তা নয়, জঘন্যতম অপরাধী ১৯৫ জনকেও মুক্তি দিয়েছিলেন। আসলে এভাবে পাকিস্তানের এবং মুসলিম বিশ্বের সাথে তিনি সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চেয়েছিলেন। সে লক্ষ্যে তিনি ইসলামি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে লাহোরে গিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোরতর বিরোধী জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথেও কোলাকুলি করেছিলেন।
স্বদেশের যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন, তিনি তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। দেশেও প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধের বিষাক্ত পরিবেশের অবসান ঘটানো তার লক্ষ্য ছিল। তা ছাড়া, সে সিদ্ধান্তের পেছনে তার এ অনুভূতিও ছিল যে তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অখণ্ড পাকিস্তানে বিশ্বাস করতেন এবং সমঝোতার ভিত্তিতে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। সময় এবং সুপরামর্শ পেলে হয়তো তিনি রাজাকার-আলবদরদেরও ক্ষমা করে দিতে পারতেন। শেখ হাসিনা পিতার দৃষ্টান্ত থেকে উপকৃত হতে পারেননি, তার স্মৃতিকে যথাযথ সম্মান দেখাতে পারেনি আওয়ামী লীগ। উল্টো ৪০ বছরের পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসাকে দেশের প্রধান বৈশিষ্ট্য করে তুলেছে। আমরা যারা গোড়া থেকেই তাকে হুঁশিয়ারি ও সুপরামর্শ দিয়েছিলাম, তাদের আশঙ্কা এখন শতগুণে সত্যে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে এখন কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না, সবাই পরস্পরকে শত্রু ভাবে, সন্দেহ করে। সবাই চায় পিঠ বাঁচাতে। তার পরিণতি কী দাঁড়িয়েছে, সেটা কি কাউকে বলে দিতে হবে?
মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য কারো মনে আছে?
বাংলাদেশে এখন কি কারো মনে আছে, কেন আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম, মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম? জেনারেল জিয়া ঠিকই বলেছিলেন, গণতন্ত্র বাংলাদেশের মানুষের রক্তে মিশে আছে, কিন্তু গণতন্ত্রটা এখন কোথায়, দয়া করে কেউ কি আমাকে দেখিয়ে দেবেন? এখন বাংলাদেশে অবাধ ও ন্যায্য নির্বাচন হতে পারে না, হতে দেয়া হয় না। কমিশনে যে সংখ্যা এবং যাদের নাম সরকার লিখে দেন, কমিশন তাদের নির্বাচিত ঘোষণা করে। ভোটদাতারা এবং সাধারণ মানুষ এখানে অবান্তর। মুখে কুলুপ এঁটে দিয়ে এবং ক্যাডার, পুলিশ ও র্যাব নামের তিন বাহিনীর ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে নৈতিকভাবে অবৈধ সরকার মুরব্বিদের নির্দেশ অনুযায়ী মূলত শোষণ ও নামমাত্র শাসন চালাচ্ছে।
বিরোধী দলগুলোকে কথা বলার অধিকার তারা দিতে চান না। পথে মিছিল করার, মুক্তাঙ্গনে সভা করার, এমনকি অনেক সময়ে রুদ্ধদ্বার সম্মেলন কক্ষেও সভা-সমাবেশ করার অধিকার বিরোধীদের দেয়া হয় না। তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এবং সর্বজনস্বীকৃত জননেত্রী খালেদা জিয়াকে সড়ক বন্ধ করে জনসমাবেশে যেতে বাধা দেয়া হয়, সম্মেলনে তার যাওয়ার কথা থাকলে পুলিশ দিয়ে সম্মেলনস্থলের প্রবেশপথ বন্ধ করে দেয়া হয়। সত্য প্রকাশ করার চেষ্টা করলে সাংবাদিকেরা মেহেরুন রুনি ও তার স্বামী সাগরের মতো খুন হতে পারেন, মাহমুদুর রহমানের মতো বিনা বিচারে কারা ভোগ এবং রিমান্ডে নির্যাতিত হওয়ার আশঙ্কা তো আছেই। শেখ মুজিব বাকশাল দিয়ে পত্রপত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা পত্রপত্রিকা এবং টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করেন পুলিশ দিয়ে। প্রতিমুহূর্তে ক্ষমতাসীনদের ভয়, তাদের দুষ্কর্ম, দুর্নীতি ও কুশাসনের কথা সাধারণ মানুষ জেনে গেলে তাদের জনরোষে পড়তে হবে। গদি দূরের কথা। যে সাবেক বিচারপতির বিতর্কিত রায়ের অর্ধেকের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশকে একটা রণক্ষেত্রে পরিণত করা হয়েছে, তিনিও এখন বলতে বাধ্য হচ্ছেন, বাংলাদেশে কে যে সরকার তিনি বুঝতে পারেন না।
পেশিশক্তি পশুশক্তিতে পরিণত
পারার কথাও নয়। পেশিশক্তি দিয়ে এ সরকার গদি দখল করে রাখতে চেয়েছিল। সে পেশিশক্তি এখন পশুশক্তি হয়ে সরকারকেই খেতে উদ্যত হয়েছে। ১৯৯৬ সালে প্রথম দফায় ক্ষমতা পেয়ে এ দৈত্যকে শেখ হাসিনা বোতল থেকে বের করে দিয়েছিলেন। লক্ষ্মীপুরের বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলামকে গডফাদার আবু তাহেরের ছেলে টুকরো টুকরো করে কেটে বস্তাবন্দী করে নদীতে ফেলে দিয়েছিল। বাংলাদেশের আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন, কিন্তু আবার গদি পেয়ে আওয়ামী সরকার তাকে ছেড়ে দিয়েছেন, সে ছেলে আবার সন্ত্রাসের তাণ্ডব চালাচ্ছে। লক্ষ্মীপুরে এখন হচ্ছে কী? আওয়ামী লীগের দুর্বৃত্তদের খুন করছে এ দলেরই অন্য দুর্বৃত্তরা। নারায়ণগঞ্জের গডফাদার শামীম ওসমান এবং ফেনীর গডফাদার জয়নাল হাজারীর খুনখারাবি সম্বন্ধে প্রশ্ন করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের ধমক দিয়েছিলেন। চট্টগ্রামের ছাত্রলীগকে তিনি একটির বদলে দশটি লাশ ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
নারায়ণগঞ্জে যে সাত খুন (এবং আরো চারজন সম্ভাব্য সাক্ষী খুন) হলো তারা কি আওয়ামী লীগের লোক নয়? যারা খুন করেছে, তারাও কি দলটির ক্যাডার নয়? সব পক্ষই কি এখন গডফাদার শামীম ওসমানের দিকে আঙুল দেখাচ্ছে না? ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার আওয়ামী লীগদলীয় চেয়ারম্যান একরামুল হক খুন হলেন। সরকারের আপন দু’জন গডফাদার জয়নার হাজারী আর নিজাম হাজারী বহু অভিযোগ করলেন পরস্পরের বিরুদ্ধে। পুলিশ গ্রেফতার করল উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা জিহাদ চৌধুরীকে। বাংলাদেশের এই হচ্ছে সর্বশেষ প্রবণতা। দেশের এমাথা থেকে ওমাথা, প্রায় সর্বত্র থেকে খবর আসছে একই রকম। আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের একদল অন্য দলকে আক্রমণ করছে, খুনখারাবি চলছে। এত দিন তারা খুন করেছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে। এখন প্রতিপত্তি আর লুণ্ঠিত সম্পদের ভাগাভাগির লোভে তারা দলের ভেতরেই ‘গৃহযুদ্ধ’ চালাচ্ছে।
দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব ছিল র্যাব আর পুলিশের ওপর। তাদের দিয়ে সরকার বিরোধী দলকে দমন, দলন, নির্যাতন ও খুনখারাবি করিয়েছে। সবাই এখন বুঝে গেছে, এ সরকারের নৈতিক অধিকার নেই গদিতে থাকার। বিভিন্ন ঘটনায় ফ্রিল্যান্স দুর্নীতি এবং কন্ট্রাক্ট কিলিংয়ে মনোযোগ দিয়েছে কোনো কোনো বাহিনী। কাউকেই নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কি সরকারের নেই। হাজার ফুট গভীর গিরিখাদের ওপর দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা ফাঁকা বুলির ফানুশ ওড়াচ্ছেন। বিদেশীদের ‘চমক’ দেখানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছেন।
এ ধরনের ভয়াবহ অবস্থা যাতে সৃষ্টি হতে না পারে সে লক্ষ্য নিয়েই জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে নিয়েছিলেন। তার স্বপ্ন অনুযায়ী, জাতিকে যদি ঐক্যবদ্ধ করা যেত, বেকার সমস্যার যদি সমাধান করা হতো, দেশের মানুষের কর্মশক্তিকে যদি দেশ গঠন ও উন্নয়নের কাজে নিয়োজিত করা যেত; বর্তমান বিভীষিকা কি তাহলে অনিবার্য হতো? নদী সংস্কার ও খাল খননের কাজ যদি চলতে দেয়া হতো, তাহলে পানির অভাবে দেশের মানুষ কি হাহাকার করত? দুর্নীতি আর চুরির দায়ে যাদের জেলে থাকার কথা, আর যাদের পাগলা গারদে রাখাই উচিত ছিল; সে লোকগুলোকে যদি ধরে ধরে মন্ত্রী বানানো না হতো, তাহলে কি সাংবিধানিক ও নৈতিক কর্তৃত্বের দেউলিয়াত্ব দেশে দেখা দিত?
দেশের মানুষের রক্তে মেশা গণতন্ত্রকে কী চোখে দেখেছিলেন শহীদ জিয়াউর রহমান? ’৭৫-এ নিষিদ্ধ পত্রপত্রিকাগুলো প্রকাশের অনুমতি দিয়েছিলেন, নতুন পত্রপত্রিকা প্রকাশের ওপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, সিপিবি ও জাসদসহ সব রাজনৈতিক দলকে তিনি আবার বৈধ ঘোষণা করেছিলেন, নতুন রাজনৈতিক দল গঠনেরও অবারিত সুযোগ করে দিয়েছিলেন। শেখ মুজিবের দুই কন্যাকে দিল্লি থেকে দেশে ফিরিয়ে আনতে তিনি আওয়ামী লীগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. কামাল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাককে দিল্লি পাঠিয়েছিলেন।
ড. কামাল ও আব্দুর রাজ্জাক যে দিল্লিতে গিয়েছিলেন, সে কথা স্বীকার করতে শেখ হাসিনা কোনো অজ্ঞাত কারণে সম্পূর্ণ নারাজ। অতীতে আমার এক কলামের প্রতিবাদে সরকারি প্রেসনোট জারি করে সে কথা অস্বীকার করা হয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার মরহুম স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার রোজনামচা থেকে কয়েকটি উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেছিলাম যে, আমার বক্তব্য সঠিক ছিল। মাঝে মাঝেই এমন উক্তি করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অযথা বিতর্ক সৃষ্টি করেন বলে অনেকেই অভিযোগ করেন। সম্প্রতি তিনি আবারো অভিযোগ করেছেন, দিল্লি থেকে ফিরে আসার পর তাকে পিত্রালয়ে ঢুকতে পর্যন্ত দেয়া হয়নি এবং তার জিনিসপত্র রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছিল।
নিত্যনতুন বিতর্ক সৃষ্টি
রাষ্ট্রপতি জিয়া সব সময় কর্মব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু তালিকা তৈরি করে এবং রসিদ নিয়ে হীরক মুকুটসহ সাড়ে ৩৩ কোটি টাকা দামের সম্পত্তি তিনি শেখ হাসিনাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। তার জিনিসপত্র রাস্তায় ফেলে রাখার প্রশ্নই ওঠে না। আসলে কারো জিনিসপত্র রাস্তায় ফেলে রাখার ঐতিহ্য কাদের? ড. ওয়াজেদ মিয়াকে তার নিজের বাড়ি সুধা সদন থেকে ব্যক্তিগত জিনিসপত্রসমেত কারা রাস্তায় বের করে দিয়েছিলেন? আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই পরমাণুবিজ্ঞানী জীবনের শেষ বছরগুলো কাটিয়েছেন বঙ্গভবনের একটি নিঃসঙ্গ কক্ষেÑ নিজের বাড়ি সুধা সদন কিংবা স্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে নয়। বেগম খালেদা জিয়াকে শেখ হাসিনা ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছিলেন।
মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিলেনÑ এ কথা শুনলেও আওয়ামী নেতারা তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন। বহু প্রমাণ আগেও দেয়া হয়েছে, কিন্তু সেসব গ্রাহ্য করতেও তারা প্রস্তুত নন। সম্প্রতি একাত্তরের প্রবাসী অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং স্বাধীন বাংলাদেশেরও প্রথম প্রধানমন্ত্রী মরহুম তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা শারমীন আহমদ তার বইতে লিখেছেন, একাত্তরের ২৫ মার্চ সন্ধ্যেবেলা তার পিতা স্বাধীনতার ঘোষণার খসড়া আর টেপরেকর্ডার নিয়ে শেখ মুজিবের বাড়ি গিয়েছিলেন, কিন্তু মুজিব সে ঘোষণা রেকর্ড করতে রাজি হননি। শারমীন আরো লিখেছেন, মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে তার পিতা তাজউদ্দীন আহমদ অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। শেখ মুজিব যাকে সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করেছিলেন সেই জেনারেল সফিউল্লাহও কয়েক দিন আগে স্বীকার করেছেন যে, স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান এবং সে ঘোষণায় তিনি আরো বলেছিলেন যে, তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিচ্ছেন।
বহুকাল আগে শেক্সপিয়রের ‘হ্যামলেট’ নাটকের অনুবাদের এক স্থানে লিখেছিলাম, কল্পনা প্রবল হয় দুর্বল শরীরে। এ সরকার সম্বন্ধে আমার প্রায়ই মনে হয়, শোকস্মৃতি মনে হলেই তাদের কল্পনা প্রবল হয়, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী জিয়াউর রহমানের পরিবারের বিরুদ্ধে মনগড়া অভিযোগ ম্যানুফ্যাকচার করতে শুরু করে।
শহীদ জিয়ার সাথে এখনকার কোনো নেতানেত্রীর তুলনা করার প্রশ্ন ওঠে না। যে অন্ধ রৌদ্রস্নাত দিন দেখেনি, ঘুরঘুট্টি অমানিশার বিভীষিকা সে বুঝবে কী করে? জিয়ার চিন্তা ও আদর্শের কথা চিন্তা করলেই বুঝতে পারি, আওয়ামী লীগ দেশটাকে সর্বনাশের দিকে কতখানি নিয়ে গেছে। হয়তো আধুনিক কোনো চাণক্যের ইশারায় নিজের দেশকে পরের হাতে তুলে দেয়ার মতলবে দেশে হিংসাদ্বেষ ও ভেদাভেদ সৃষ্টি এবং জাতীয় ঐক্য অসম্ভব করে তোলা হয়েছে। গভীর ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র করে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু অনেক দুঃখ ভুগে ভুগে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে জিয়ার আদর্শ ক্রমেই বেশি ভাস্বর হয়ে উঠছে। বিচার করার সময় যখন আসবে ষড়যন্ত্রকারীদের পরিচয় সেদিন সারা বিশ্বের জানা হয়ে যাবে।
লন্ডন, ২৮.০৫.১৪
বিবিসি বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান
serajurrahman34@gmail.com