অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও দেশের অধিকাংশ হজযাত্রী মধ্যস্বত্বভোগী গ্রুপ লিডারদের মাধ্যমেই হজে যাওয়ার টাকা জমা দিয়েছেন। নতুন লাইসেন্স প্রদানের সুবাদে আগের অনেক গ্রুপ লিডার এবার নিজের নামের লাইসেন্সে হজযাত্রী সংগ্রহ করলেও এখনো ৭০ ভাগ হজযাত্রী গ্রুপ লিডারদের মাধ্যমে হজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন এবং গ্রুপ লিডাররা ইতোমধ্যেই ধরকষাকষি করে এজেন্সিগুলোর সাথে সর্বনিম্ন দুই লাখ ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে তাদেরকে পাঠানোর জন্য চুক্তিবদ্ধ হচ্ছেন। গ্রুপ লিডাররা সারা দেশ চষে বেড়িয়ে হজযাত্রী সংগ্রহ করেছেন। নতুনভাবে সাত শতাধিক লাইসেন্স প্রদান এবং গ্রুপ লিডারের সংখ্যাও বৃদ্ধির কারণে তাদের মধ্যে এবার স্বল্পমূল্যে হজযাত্রী সংগ্রহের প্রতিযোগিতা চলছে। যেখানে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় সর্বনিম্ন প্যাকেজ দুই লাখ ৯৫ হাজার ৭৭৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে সেখানে হজযাত্রীদের কাছ থেকে ১০ হাজার থেকে ৪০-৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত কম নেয়া হচ্ছে।
ফলে এবারো আগের মতোই গ্রুপ লিডারের মধস্থতায় যাওয়া হজযাত্রীরা নানা ভোগাান্তিতে পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। হাব ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বিমানভাড়া, বাসাভাড়া এবং খাওয়ার টাকার হিসাব করেই প্যাকেজ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর চেয়ে কম টাকায় কোনো এজেন্সি হজযাত্রী নিলে তাকে প্রতারণার আশ্রয় নিতে হবে এবং তার পক্ষে হজযাত্রীদের ন্যূনতম সেবা দেয়াও সম্ভব হবে না। গত বছরও গ্রুপ লিডারদের প্রতারণার কারণে দুই শতাধিক হজযাত্রী হজে যেতে পারেননি। এ ছাড়া নিম্নমানের বাড়িতে রাখা, নিম্নমানের খাবার পরিবেশন করাসহ হজ ব্যবস্থাপনায় অনিয়মের জন্য দুই শতাধিক এজেন্সিকে বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, গ্রুপ লিডাররা কোথাও নিজে এজেন্সির মালিক, আবার কোথাও এজেন্সির প্রতিনিধি, মোয়াল্লেম, হজকাফেলা ইত্যাদি নামে হজযাত্রী সংগ্রহ করছেন। স্থানীয় মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিন, মাদরাসা শিক্ষকসহ ধর্মীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সাথে জড়িতরাই হজযাত্রী সংগ্রহের এই কাজটিতে জড়িয়ে পড়ছেন।
শেখ নাজিম উদ্দিন আহম্মেদ নামে একজন নিজেকে এজেন্সি মালিক দাবি করে খুলনার ৭ নম্বর কেডি এ এভিনিউ ময়লাপোতা মোড়ে নিজস্ব অফিস সাজিয়ে ঢাকার ঠিকানায় অবস্থিত তিনটি এজেন্সি- আল আমিন ইন্টারন্যাশনাল, আবাবিল ট্রাভেলস ও মারিয়া ট্রাভেলসের নামে হজযাত্রী সংগ্রহ করছেন। তিনি সর্বনিম্ন প্যাকেজ মূল্য থেকে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা কমে পর্যন্ত হজযাত্রী সংগ্রহ করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে ফোনে শেখ নাজিম উদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথমে আবাবিল হজকাফেলার নামে হজযাত্রী সংগ্রহের কথা স্বীকার করলেও পরে তিনি নিজেকে একটি এজেন্সির পার্টনার দাবি করেন। তবে কোন্ এজেন্সির পার্টনার জানতে চাইলে তা জানাতে অস্বীকৃতি জানান। গ্রুপ লিডার হিসেবে প্যাকেজ মূল্যের চেয়ে কমে হজযাত্রী সংগ্রহের অভিযোগের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি ুব্ধ হয়ে বলেন, ‘আমি এক লাখ টাকায় এমনকি বিনা পয়সায় হজ করাব তাতে আপনার অসুবিধা কোথায় ?’
একইভাবে মোহাম্মদ নায়েম উল্লাহ পাপ্পু নামে একজন খুলনায় ৩৭, ফরাজীপাড়া মেইন রোড (বায়তুল আমান জামে মসজিদের পাশে) অফিস নিয়ে নিজের লাইসেন্স বলে দাবি করে ঢাকার দু’টি এজেন্সি- ইকো এভিয়েশন সার্ভিসেস ইন্টারন্যাশনাল ও হাশেম ইন্টারন্যাশনালের নামে, ফয়েজ শরীফ উদ্দিন ও মুফতি রফিকুল ইসলাম নামে দুইজন ঢাকার আমাদা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের নামে ১৮ কেডি এভিনিউ, বনি আমিন তালুকদার ১ নম্বর জুল প্লাজা (দ্বিতীয়তলা) নিরালা মোড়ে সাইনবোর্ড লাগিয়ে, মুফতি ইব্রাহীম, মো: ইব্রাহীম সুপার খিদমাহ ট্রাভেলসের নামে এবং সাইফুদ্দিন ও হাফেজ জাকির হোসেন নামে দুইজন আকবর হজ গ্রুপের নামে খুলনায় হজযাত্রী সংগ্রহ করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এরা হজযাত্রীদের হারাম শরীফের কাছে রাখার কথা বলে এবং ক্ষেত্রবিশেষে দুই লাখ ৩০-৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে হজযাত্রীদের পাসপোর্ট সংগ্রহ করছেন বলে জানা গেছে।
হাবের সিনিয়র সহসভাপতি আব্দুল কবির খান জামানের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হজ নীতিমালা এবং হাবের নিয়ম অনুযায়ী একটি এজেন্সির একাধিক অফিস খুলে হজযাত্রী সংগ্রহ করার কোনো সুযোগ নেই। এটা কেউ করে থাকলে সেটা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। তিনি বলেন, প্যাকেজ মূল্যের কমে টাকা নেয়া যাবে না মর্মে ধর্ম মন্ত্রণালয় ও হাবের কড়া নির্দেশনা রয়েছে। কেউ নিয়ে থাকলে এবং এ ধরনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ ব্যাপারে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (হজ) জাহাঙ্গীর আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কম টাকায় হজযাত্রী সংগ্রহের কিছু অভিযোগ আমরাও পেয়েছি। অভিযোগ পাওয়ার সাথে সাথে প্রত্যেক এলাকায় মেজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপারকে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অনুরোধ করেছি। তিনি বলেন, গ্রুপ লিডারদের দৌরাত্ম্য এবং কম টাকায় হজযাত্রী নেয়ার প্রবণতা রোধে আমরা সতর্ক আছি। তিনি বলেন, যিনি সরকার নির্ধারিত প্যাকেজ মূল্যের কমে হজযাত্রী নেবেন তিনি কি তার বাড়ি থেকে জমি বিক্রি করে হজযাত্রীদের হজ করাবেন? গ্রুপ লিডারদের খপ্পরে পড়ে হজযাত্রীরা দুর্ভোগে পড়েন এবং প্রতারণার শিকার হয়ে থাকেন জানিয়ে এই হজকর্মকর্তা বলেন, ইতোমধ্যেই আমরা এ ব্যাপারে সচেতনতা তৈরির জন্য বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচারণা চালিয়েছি।