জামায়াতের বিচার থেকে সরে আসছে সরকার?

0
121
Print Friendly, PDF & Email

আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনে মুক্তিযুদ্ধকালে অপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে মামলা ও বিচার করা আপাতত সম্ভব নয়৷
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তিনটি কারণ উল্লেখ করে গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে এ কথা বলেন৷
জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি হিসেবে সাত মাস ধরে তদন্ত হয়েছে৷ দুই মাস ধরে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ প্রস্তুতির কাজ চলছিল৷ এ অবস্থায় মন্ত্রীর এই বক্তব্যে প্রশ্ন উঠেছে, সরকার কি তাহলে জামায়াতের বিচার করার উদ্যোগ থেকে সরে আসছে?
আইনমন্ত্রী যে তিনটি কারণ উল্লেখ করেছেন সেগুলো হল—প্রথমত, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এ সংগঠনের শাস্তির বিধান নেই।
দ্বিতীয়ত, জামায়াতের নিবন্ধনের ব্যাপারে একটি মামলা ইতিমধ্যে আপিল বিভাগে আছে৷ এর মধ্যে ট্রাইব্যুনালের আইনে কোনো অভিযোগ আনা হলে ওই মামলায় কোনো প্রভাব পড়বে কি না, তা দেখতে হবে৷ এই পর্যায়ে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমি মনে করি, প্রভাব পড়বে৷ এখন এসব অন্যান্য পারিপার্শ্বিক দিক বিবেচনা করে এগিয়ে যেতে হবে৷ সে ক্ষেত্রে সময় লাগবে৷’
তৃতীয়ত, অন্যান্য আইনে বলা আছে, যদি কোনো সংগঠন, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি অপরাধ করে, তবে ওই সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা নিয়ন্ত্রককে দায়দায়িত্ব নিতে হবে এবং দায়ী কর্মকর্তাদের শাস্তি দেওয়া হবে। জামায়াতের যেসব নেতা মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন, তাঁদের ইতিমধ্যে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বারের মতো তাঁদের আবার শাস্তি হলে তা আগের শাস্তির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে কি না, তা বিবেচনা করতে হবে।
সম্প্রতি ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের অন্তর্দ্বন্দ্বে জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলা করা নিয়ে অচলাবস্থা তৈরি হয়। এসব বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করতে সরকার বদ্ধপরিকর, কিন্তু অবশ্যই আইনের সুনির্দিষ্ট বিধান প্রতিপালন করে। বিচার যাতে কোনোভাবে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সে জন্য এসব ব্যাপারে আইনের অবস্থান আরও স্পষ্ট করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সবকিছু বিবেচনা করে জামায়াতকে রাজনৈতিক দল হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর বিষয়টি আরও ভাবনাচিন্তা করে নিতে হবে। এখন সেটার সময় নয়৷ আজ জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলা হবে, কাল আইন পরিবর্তন করা হবে, আমি এর পক্ষে নই। আমাকে সারা পৃথিবীতে ব্যাখ্যা দিতে হচ্ছে কাদের মোল্লার ব্যাপারে। কোনো বিষয়ে কেউ প্রশ্ন তুলুক, আমি তা চাই না।’
‘জামায়াতের সঙ্গে সরকারের সমঝোতা’ বিষয়ে আলোচনা ও সন্দেহ আছে৷ এখন বিচার থেকে পিছিয়ে গেলে আওয়ামী লীগ কী জবাব দেবে—এমন প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো আলাপ-আলোচনা হতে পারে না৷ কোনো সমঝোতার প্রশ্নই ওঠে না৷ কারণ, আওয়ামী লীগ মূলত যে দুটো স্তম্ভের ওপরদাঁড়িয়ে, সে দুটো হচ্ছে স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ৷ এ দুটো নিয়েই আমরা সোনার বাংলা গড়ার চেষ্টা করছি৷ জামায়াত এর কোনোটাই বিশ্বাস করে না৷ আমরা অসাম্প্রদায়িক নীতিতে বিশ্বাসী৷ অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, রাজনৈতিক কারণে এমন সমঝোতা হতে পারে কি না৷ প্রশ্ন থাকতে পারে৷ কিন্তু জামায়াত যা করছে, তা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড৷ এসব কর্মকাণ্ড আওয়ামী লীগ বা সরকার কোনো দিন সমর্থন করবে না৷ সে ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে সমঝোতার প্রশ্নই ওঠে না৷’
জামায়াতের বিচার বিষয়ে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে যোগাযোগ করা হলে তদন্ত সংস্থা ও রাষ্ট্রপক্ষের মামলাসংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি মুখ খুলতে রাজি হননি। তবে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিচারের দাবিতে আন্দোলনকারীরা৷ তাঁরা বলেছেন, আইনমন্ত্রীর এ বক্তব্য অত্যন্ত দুঃখজনক ও অগ্রহণযোগ্য। তাঁর এ বক্তব্য গোটা জাতি ও ৩০ লাখ শহীদ পরিবার প্রত্যাখ্যান করবে।
গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল-২ জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দিলে দেশের তরুণ প্রজন্ম সংক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। রাজধানীর শাহবাগে গড়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চ। তারা সরকারের কাছে কাদের মোল্লার রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের দাবি জানায়। ১৭ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনালের দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে উভয় পক্ষের আপিলের সমান সুযোগ ও সংগঠনের বিচারের বিধান করে সংশ্লিষ্ট আইনের সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস হয়। ওই সময়ে ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ হিসেবে আনিসুল হক বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর ৩ ধারা সংশোধন করে সংগঠনের বিচারের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ প্রমাণিত হলে অপরাধী সংগঠনের শাস্তি কী হবে, এ বিষয়ে আইনের ২০ ধারায় কিছু বলা হয়নি। এ ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালের আইনে আবার প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হতে পারে। ২০১৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় তাঁর ওই বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল৷
গত বছরের ১৮ আগস্ট তদন্ত সংস্থা জামায়াতের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত শুরু করে। সাত মাস তদন্তের পর তারা প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে। ওই সময়ে প্রথম আলো আনিসুল হকের কাছে আবারও আইনের অস্পষ্টতা নিয়ে জানতে চাইলে তখন তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। গত ২৪ মার্চ এ বিষয়ে প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়৷
২৭ মার্চ জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ িটপুর কার্যালয়ে জমা দেওয়া হয়। ওই দিন তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, তুরিন আফরোজের নেতৃত্বে সাত সদস্যের কৌঁসুলি দল তদন্ত প্রতিবেদন ও আনুষঙ্গিক নথি যাচাই করে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ তৈরি করবে। তারপর সেটি ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য দাখিল করা হবে। জামায়াতের শাস্তি কী চাওয়া হবে, জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘তদন্ত সংস্থা দলটি নিষিদ্ধের সুপারিশ করেছে৷ আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখব, নিষিদ্ধের শাস্তি, নাকি সম্পদ বাজেয়াপ্ত, নাকি উভয় শাস্তিই চাইব।’
গত ১৩ এপ্রিল বিদেশে চিকিৎসার জন্য এক মাসের ছুটিতে যান গোলাম আরিফ টিপু। ২০ এপ্রিল সৈয়দ হায়দার আলীকে এক মাসের জন্য ভারপ্রাপ্ত প্রধান কৌঁসুলির দায়িত্ব দেয় আইন মন্ত্রণালয়। এর পর থেকে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৫ মে জামায়াতের বিষয়ে তদন্তের সব নথি ভারপ্রাপ্ত প্রধান কৌঁসুলির কাছে হস্তান্তরের নোটিশ দেওয়া হলে মামলা পরিচালনার জন্য গঠিত কৌঁসুলিদের দলটি ১৯ মে অভিযোগ প্রস্তুতির কাজ বন্ধ করে দেয় এবং প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ টিপুর জরুরি সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা চেয়ে চিঠি পাঠায়। এর মধ্যে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ও রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান সমন্বয়ক এম কে রহমানকে অব্যাহতি দেয় সরকার।
রাষ্ট্রপক্ষের অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মনে হয় সমন্বয়কের আর দরকার নেই। তবে প্রসিকিউশনকে গতিশীল করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ গোলাম আরিফ টিপু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি তো শুনেছি উনি অসুস্থ৷ ছয় মাসের জন্য ছুটি চেয়ে চিঠি পাঠানোর কথা৷ উনি ছুটি শেষ করে এসে মন্ত্রণালয়ে কোনো রিপোর্ট করেননি৷’
জামায়াতের বিচার নিয়ে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে-বিদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পর্কে আইনমন্ত্রীর বিন্দুমাত্র ধারণা থাকলে এসব কথা বলতেন না। এই আইনের আওতায় অপরাধী সংগঠনকে সাজা দেওয়া যায় কি না, এটা আইনমন্ত্রী বা সরকারের না, ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার। তাঁর উচিত রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের কোন্দল নিয়ে মাথা ঘামানো। জামায়াতের বিরুদ্ধে নিবন্ধনের মামলা ও সংগঠন হিসেবে মামলা দুটি সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। আমি তাঁর বক্তব্য শুনে স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি।’
শাহরিয়ার কবির আরও বলেন, ‘আইনমন্ত্রীর এ বক্তব্যে বিচারের ব্যাপারে মানুষের কাছে ভুল সংকেত যাচ্ছে। জামায়াতের প্রশ্নে সরকার যদি কোনো ধরনের ছাড় দেওয়ার চেষ্টা করে, তবে তা আওয়ামী লীগের জন্য আত্মঘাতী হবে।

শেয়ার করুন