অবরুদ্ধ সুপ্রিমকোর্ট

0
158
Print Friendly, PDF & Email

সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে মহাসমাবেশ করতে না দেয়ার প্রতিবাদে আদালত বর্জনসহ টানা পাঁচ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম। শনিবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে খালেদা জিয়াকে নিয়ে সমাবেশ করে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন ফোরামের সভাপতি ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া।
কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত সারা দেশের আদালত বর্জনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এছাড়া সোমবার সারা দেশের আইনজীবী সমিতিতে বিক্ষোভ সমাবেশ, মঙ্গলবার মানববন্ধন এবং বুধবার ও বৃহস্পতিবার কালো ব্যাজ ধারণ এবং কালো পতাকা মিছিল করবেন আইনজীবীরা। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত এবং অ্যাডভোকেট চন্দন সরকারসহ সব গুম, খুন অপহরণের বিচার দাবিতে ফোরাম সারা দেশের আইনজীবীদের নিয়ে এ মহাসমাবেশের ডাক দেয়।
সমাবেশকে কেন্দ্র করে সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে শুক্রবার রাতে মঞ্চ তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু ‘অনুমোদন না থাকার’ অভিযোগে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী শুক্রবার রাত ১টার দিকে ওই মঞ্চ ভেঙে দেয়। মাইক কেড়ে নেয়। চেয়ার-টেবিল সরিয়ে ফেলে। বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এ নিয়ে আইনজীবীদের সঙ্গে পুলিশের বাকবিতণ্ডা হয়। সারা রাত সুপ্রিমকোর্টের চারপাশ কড়া নিরাপত্তা ও নজরদারিতে রাখে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। তালা ঝুলিয়ে ভোর থেকেই সব গেটে পুলিশের অবস্থান। গণমাধ্যমকর্মী ছাড়া কাউকে আদালত চত্বরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। তারপরও মহাসমাবেশ করার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন আইনজীবীরা।
সকালে আইনজীবীরা সমাবেশে যোগ দিতে আসেন। মাজার গেট দিয়ে প্রবেশ করার চেষ্টা করেন তারা। ফলে এ গেটে ছিল সবচেয়ে বেশি কড়াকড়ি। সুপ্রিমকোর্টের ভেতরে ও বাইরে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল। ছিল তিন স্তরের পুলিশি ব্যারিকেড আর কাঁটাতারের বেড়া। এত নিরাপত্তা বলয় ভেদ করে কেউই ঢুকতে পারেননি সমাবেশস্থলে। সমাবেশস্থলে ঢুকতে না দেয়ার প্রতিবাদে আইনজীবীরা মাজার গেটের সামনে ছোট ছোট দলে বিক্ষোভ মিছিল করতে থাকেন। ফলে গোটা এলাকা প্রতিবাদ সমাবেশে পরিণত হয়। নানা ধরনের স্লোগান দিয়ে তারা ঢোকার চেষ্টা করেন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে আইনজীবীদের টানাহেঁচড়া শুরু হয়। সেখান থেকে ১৯ জনকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ।
আটককৃতদের মধ্যে রয়েছেন : ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি খোরশেদ আলম মিয়া, শরীয়তপুর আইনজীবী সমিতির সভাপতি মুসলেম খান, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্য মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান খান, মোরশেদা খাতুন শিল্পী, ব্যারিস্টার আবিদুল হক, অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান, শাহজাহান হোসেন, আনিসুর রহমান, মোঃ আনিসুজ্জামান, কামরুল হাসান, আরিজ আহমেদ, এএসএম মাসুম খন্দকার, জহিরুল হাসান মুকুল, রমজান আলী, তোফাজ্জল হোসেন, খায়রুল ইসলাম মিন্টু, জহির, আমিরুল ইসলাম ও দিনমজুর মাসুদ।
রমনা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার এসএম শিবলী নোমান সন্ধ্যায় যুগান্তরকে জানান, সুপ্রিমকোর্টে সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আইনজীবীরা সমাবেশ করতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তারা অনুমতি আছে কিনা জানতে চান। তারা কোনো ধরনের অনুমতিপত্র দেখাতে না পারায় পুলিশ বাধা দেয়। আইনজীবীরা পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে সমাবেশ করতে চাইলে পুলিশের কর্তব্য পালনে বাধা দেয়ার অভিযোগে তাদের আটক করা হয়। তিনি জানান, সন্ধ্যায় তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
সকাল পৌনে ১০টার দিকে খন্দকার মাহবুব হোসেনসহ কয়েকজন আইনজীবী সুপ্রিমকোর্টের মাজার গেটের সামনে অবস্থান নেন। এ সময় খন্দকার মাহবুব সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের কর্মসূচি কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল না। গুম, খুন, হত্যার প্রতিবাদে একটি সমাবেশ। অথচ কাউকেই ভেতরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। আমি সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অথচ আমাকেই ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। এমন নজির কখনও দেখিনি। তিনি সরকারকে উদ্দেশ করে বলেন, আমরা কোনো উচ্ছৃংখল আচরণ করতে চাই না। তবে তেমন আচরণ করতে যেন বাধ্য করবেন না। বক্তব্য শেষে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী শুধু খন্দকার মাহবুব হোসেনকে ভেতরে ঢোকার সুযোগ দেয়।
সকাল ১০টার দিকে সুপ্রিমকোর্টের মাজার গেটে পৌঁছান ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া। আদালত চত্বরে ঢোকার পথে পুলিশ তার গাড়িটি আটকে দেয়। গাড়ি থেকে নেমে রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, আমি আমার চেম্বারে যাচ্ছি। আমি একজন অসুস্থ ব্যক্তি, কেন বাধা দেয়া হচ্ছে? এভাবে কাউকে সুপ্রিমকোর্টে ঢুকতে না দিয়ে সরকারের লাভটা কী হচ্ছে! এ ধরনের আচরণের জন্য কী আমরা গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধ চেয়েছি? ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া আরও বলেন, সরকার শুধু গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবাধিকারকে খর্ব করছে না, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসনকে ধ্বংস করছে। যারা গুম, খুন, অপহরণ করছে তাদের বের করতে পারছে না। এগুলো বন্ধ না করে যারা এগুলোর প্রতিবাদ জানাতে এসেছে তাদের সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। এর জন্য জাতির কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
এদিকে কাউকে সুপ্রিমকোর্টের ভেতরে ঢুকতে না দেয়া হলেও আইনজীবী ফোরামের সেক্রেটারি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ প্রায় অর্ধশত আইনজীবী আগের রাত থেকেই আদালত চত্বরে অবস্থান করছিলেন। তারা ভেঙে দেয়া মঞ্চস্থলে সকাল থেকে সমাবেশ শুরু করেন। মাইক না থাকায় হ্যান্ডমাইক ব্যবহার করা হয়। মঞ্চ না থাকায় চেয়ারে বসেই সকাল ১০টায় সমাবেশ শুরু করে। সেখানে বক্তব্য রাখেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী, সমিতির সাবেক সভাপতি এ জে মোহাম্মদ আলী, সাবেক সম্পাদক সাইদুর রহমান, আবেদ রাজা, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল প্রমুখ। সমাবেশস্থলে পুলিশ বেষ্টনী ছিল। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে খন্দকার মাহবুব হোসেন ও রুহুল কবির রিজভী সুপ্রিমকোর্ট মাজার গেট দিয়ে বের হয়ে আসেন।
এ সময় সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের সমাবেশ চলছে ও চলবে। তিনি বলেন, অতীতেও সুপ্রিমকোর্টে অনেক সমাবেশ হয়েছে। কোনোটির অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন পড়েনি। তারপরও আমরা সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রারকে অবহিত করেছি। তিনি প্রধান বিচারপতির প্রতি প্রশ্ন রেখে বলেন, সুপ্রিমকোর্টের সব ফটক তালাবদ্ধ কেন? আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই। আর যেসব আইনজীবী গ্রেফতার হয়েছেন তাদের অবিলম্বে মুক্তির দাবি করছি। তিনি বলেন, সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে কিছু করতে হলে তার অনুমতি দেয়ার মালিক আমি। এ সময় তিনি এদেশের মানুষের ওপর যেভাবে গুম, খুন, অপহরণ নির্যাতন চলছে, তা দেখার জন্য বিশ্ব বিবেকের প্রতি আহ্বান জানান। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে সুপ্রিমকোর্ট চত্বরের ভেতরে চলা সমাবেশ শেষ করে সবাই প্রেস ক্লাবের দিকে চলে যায়। বেলা ১২টার পরে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া পৌঁছলে প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে মহাসমাবেশ শুরু হয়।
এদিকে সকাল থেকেই সুপ্রিমকোর্টের তিনটি ফটক, আদালত চত্বরসহ আশপাশের এলাকায় বিপুল সংখ্যক আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত ছিল। এছাড়া প্রেস ক্লাবের পাশে আবদুল গণি রোড, দোয়েল চত্বর থেকে কদম ফোয়ারা পর্যন্ত রাস্তা আটকে দেয়া হয়। এ সময় এ এলাকায় যান চলাচলের ওপরও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। ফলে পুরো এলাকায় যানজটেরও সৃষ্টি হয়ে যায়। মোতায়েন ছিল পুলিশের কয়েকটি জলকামান ও রায়ট কার। সমাবেশের কারণে শুক্রবার রাত থেকে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সুপ্রিমকোর্ট ছাড়াও প্রেস ক্লাব, শাহবাগ, মৎস্য ভবন, সচিবালয়, পল্টন, দৈনিক বাংলা, গুলিস্তান, বঙ্গবাজার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা ছিল।

শেয়ার করুন