বেশ কয়েকদিন চাচার সঙ্গে দেখা হয় না। তিনি হঠাৎ চুপ মেরে গেলেন কেন তা বুঝলাম না। পরে মনে হলো, আমি নিজেও চাচার খবরাখবর নিতে পারতাম। তিনি অসুস্থ হতে পারেন, ঢাকার বাইরে যেতে পারেন। এমতাবস্থায় আমার দিক থেকে তার খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন ছিল। চাচাকে ফোন করতে তিনি বললেন, তোমার সঙ্গে কথা আছে। চলে এসো।
চাচার বাড়িতে পৌঁছানোর পর যথারীতি বৈঠকখানায় বসে আমাদের আলোচনা শুরু হলো। চাচা বললেন, দেখলে তো? শেষ পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় র্যাবের তিন সাবেক সদস্যকে রিমান্ডে নেয়া হলো। সামান্য ব্যাপারটাকে নিয়ে মিডিয়ায় এত তোলপাড় করার কোন কারণ ছিল না।
কোনটা সামান্য ব্যাপার? আমি প্রশ্ন করলাম, সাত
খুনের ঘটনাকে আপনি সামান্য ব্যাপার বলছেন?
না। আমি তা বলছি না। আমি বোঝাতে চাচ্ছি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যেখানে ব্যবস্থা নিচ্ছে, সেখানে তদন্ত আর বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে এত হৈ-হল্লার কোন মানে হয় না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেখানে বলে দিয়েছেন, নারায়ণগঞ্জের খুনের ঘটনায় কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। তারপর আর কথা কি?
চাচা! মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথাটা তার রুটিন বক্তব্য। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছার সঙ্গে বাস্তব ঘটনার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না বলে দেশের মানুষ উদ্বিগ্ন।
আমাদের দেশের মানুষের ধৈর্য খুব কম।
আমি তো বলবো ধৈর্য খুব বেশি। হাইকোর্টের নির্দেশের পরেও র্যাবের তিন সাবেক সদস্যকে ছয়দিনের মধ্যে গ্রেপ্তার না করায় মানুষ কেবল মনে মনে বিক্ষুব্ধ হয়েছে। কোন নৈরাজ্য সৃষ্টি করেনি।
কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আদালতের কার্যক্রমে তদন্ত বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
আমি বললাম, সাত খুনের ঘটনায় তদন্তের যতটা অগ্রগতি হয়েছে, তা নিহতদের স্বজন ও আইনজীবীদের চাপেই হয়েছে।
এখন তো আর কোন অসুবিধা নেই। আইন তার নিজস্ব প্রক্রিয়ায় আপন গতিতে চলবে।
চাচা! আমাদের দেশে আইন তার নিজস্ব প্রক্রিয়ায় চলে না। আইনকে প্রশাসনিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। তাছাড়া, আইনের নিজস্ব গতি বলেও কিছু নেই। আইনের গতি নির্ভর করে ব্যক্তিনির্ভর পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর।
তার মানে বিচার ব্যবস্থার ওপর তোমার আস্থা নেই?
কথাটা ঠিক নয়। বিচার ব্যবস্থা হচ্ছে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের সর্বশেষ আশ্রয়। তবে এক্ষেত্রে আমি রবীন্দ্রনাথের কথাটাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’।
এ কথার ব্যাখ্যা কি?
খুবই সোজা। লিমনের মতো একজন অসহায় ছাত্রের বিরুদ্ধে র্যাবের মামলাকে তুলে নেয়া হবে বলেও ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে ত্বকী হত্যা মামলার বিচার হচ্ছে না। ত্বকী হত্যার বিচারে ক্ষমতাসীনরা বাধা দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সাগর-রুনি হত্যাকা- যে তিমিরে ছিল, আজও সেই তিমিরে। আবু বকর সিদ্দিকের অপহরণের রহস্য ভেদের কাজ এক পা-ও এগোয় নি।
কিন্তু বিশ্বজিৎ হত্যাকা-ে ছাত্রলীগের ছেলেদেরকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। তাদের কোন ছাড় দেয়া হয়নি। এসব কথা কেন বলো না?
চাচা! বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে আমি আর কথা বলতে চাই না। এদেশে খুনি ও ফাঁসির দ-প্রাপ্ত আসামিদের শেষ পর্যন্ত ক্ষমা করে দেয়া হয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় খুন-ধর্ষণসহ হাজার হাজার মামলার আসামিদের ওপর থেকে অভিযোগ তুলে নেয়া হয়। এসব কথা বলে লাভ কি?
তাহলে আমরা আমাদের আলোচনা অন্যখাতে প্রবাহিত করতে পারি। কি বলো?
আপনি কি ভারতের নির্বাচনের কথা তুলতে চাইছেন?
ঠিক ধরেছ। ভারতের নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে তোমার কি অভিমত, বলো।
তার আগে আপনি বলুন ভারতের নির্বাচন নিয়ে আপনার কি মতামত?
আমার মনে হয়, নরেন্দ্র মোদিকে জিতিয়ে দেয়ার ব্যাপারে খালেদা জিয়ার অবদান আছে।
কি বলছেন আপনি?
ঠিকই বলছি। ভারতের নির্বাচনের সময় খালেদা জিয়ার দল তিস্তার পানি নিয়ে লং মার্চ না করলে কংগ্রেসের এমন ভরাডুবি হতো না।
বিএনপি’র লং মার্চের সঙ্গে ভারতের ইলেকশনের সম্পর্ক কি?
আছে। অবশ্যই আছে। নইলে ওই সময়ে বিএনপি লং মার্চ করলো কেন? আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অবশ্য তিস্তার পানির ব্যাপারে কংগ্রেস সরকারকে দায়মুক্তি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির ওপর দায় চাপাতে চেষ্টা করেছেন। ভেবেছিলেন নির্বাচনের সময় কথাটা বলে মমতার জনপ্রিয়তা কিছুটা কমানো যাবে।
শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো? আমার প্রশ্ন।
লোকসভা নির্বাচনে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য খুবই কাজে দিয়েছে। ফলে মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গের সবগুলো আসন দখল করতে পারেননি। মোট ৪২টি আসনের মধ্যে তৃণমূল ৩৪টি আসন পেয়েছে। তুমি তো পররাষ্ট্রনীতি বোঝো না, তাই এসব বুঝবে না।
চাচার এসব উদ্ভট তত্ত্ব শুনলে আমার মস্তিষ্কের ভেতর কলকব্জা উল্টো দিকে ঘুরপাক খায়। আমি পররাষ্ট্রনীতি বুঝি না ঠিকই, কিন্তু যতটুকু বুঝি, তাতে মনে হয়, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অকারণে ও অনাকাঙিক্ষতভাবে অসময়ে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। অথচ নির্বাচনী বক্তৃতায় নরেন্দ্র মোদি যখন স্পষ্টভাবে বলেছেন, বাংলাদেশের অভিবাসীদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে, তখন মমতা ব্যানার্জি তার প্রতিবাদ করেছেন। নরেন্দ্র মোদির সরকার ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ওপর যে সব চাপ সৃষ্টি করতে পারে, তা রুখতে, আমার ধারণা, মমতা ব্যানার্জি হেল্পফুল হতে পারেন। সেক্ষেত্রে কি মনে করে নির্বাচনের সময় এহেন বাক্যবাণ ছোড়া হলো, তা আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানে বোধগম্য নয়।
চাচা বললেন, কি ব্যাপার! চুপ করে আছো যে! ভারতের লোকসভা নির্বাচন নিয়ে তোমার মন্তব্য কি? নির্বাচনের ফলাফলকে তুমি কিভাবে দেখছো?
ভারতের ওই নির্বাচন বহুমুখী চমক সৃষ্টি করেছে। প্রথমত, এই নির্বাচন ভারতবাসীকে গোষ্ঠীতন্ত্র বা উত্তরাধিকারের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছে। উপমহাদেশের রাজনীতিতে এটি একটি নতুন বার্তা।
চাচা সাগ্রহে আমার সুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তারপর?
আমি জানালাম, নরেন্দ্র মোদির উত্থানের বড় কারণ তিনি এলিট শ্রেণীভুক্ত নন। তিনি ভারতের সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি।
তা বুঝলাম। চাচা উষ্মার সঙ্গে বললেন, কিন্তু তার হাত তো মুসলমানদের রক্তে রঞ্জিত। তিনি একজন সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি।
হ্যাঁ। তার রাজনৈতিক সাফল্যের বড় কারণ সাম্প্রদায়িকতা।
জেনেশুনে তুমি কি তাকে সাপোর্ট করবে?
আমার বা আমাদের সাপোর্ট করা বা না করায় কিছু যায় আসে না। ভারতের জনগণ একচেটিয়াভাবে তাকে সমর্থন দিয়েছে।
তার মানে, ভারতের জনগণের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা আর কাজ করছে না?
হতে পারে।
তুমি কি মনে করো ভারত একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিণত হতে চলেছে?
ভারতকে এখন একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র বলা যায়।
পাশাপাশি আমরা তো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র নই। আমরা একটি ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। তাহলে আমাদের উভয় প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক কেমন হবে?
সেটা সময়ই বলে দেবে। ভারতে রামরাজ্য কায়েম হবে আমাদের দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি উৎসাহিত হবে, এরূপ ধারণা করা যায়।
এমন একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে ভারতের জনগণ তাদের নেতা হিসেবে মেনে নিলো কি ভাবে?
এর প্রধান কারণ নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত দক্ষতা, উন্নয়নে কমিটমেন্ট ও দুর্নীতি বিরোধী মনোভাব।
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মধ্যেও কিন্তু এই তিনটি গুণ বিদ্যমান।
চাচা! আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কোনরকম তুলনা না করাই ভাল।
সবাই বলছে, বাংলাদেশ ও ভারত রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সমতা, সম্মান ও পারস্পরিক সৌহার্দ্য নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে।
রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই সম-আচরণ আশা করি। আমি বললাম, তবে আমাদের দুই সরকারের স্ট্যাটাস এক নয়।
কি বলতে চাও তুমি? চাচা আমার দিকে দু’চোখ বিস্ফোরিত করে তাকালেন।
আমি বিনম্র স্বরে বললাম, চাচা! ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত। আর আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সরকার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত।