দেশজুড়ে তীব্র দাবদাহে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে জনজীবন। ভ্যাপসা গরমে ঘরে বাইরে কোথাও স্বস্তি নেই মানুষের। প্রচ- গরমে বাড়ছে ডায়রিয়া, কলেরাসহ পানিবাহিত রোগব্যাধি। বৃষ্টি না হওয়ায় কোনভাবেই কমছে না গরমের মাত্রা। গ্রীষ্মের তপ্ত রোদে ফেটে চৌচির হচ্ছে মাটি। গাছের পাতা পর্যন্ত নড়ছে না। পিচের রাস্তায় পা ফেলারও উপায় নেই। গত প্রায় ২ মাস ধরে দেশব্যাপী দাবদাহ বিরাজ করায় তীব্র গরমে হাঁসফাঁস করছে মানুষ এবং প্রাণীকুল। গরমের কারণে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জনজীবন অচল হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বিশেষ করে দুস্থ দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষের কষ্ট চরমে পৌঁছেছে। এ মাসের শুরুর দিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে কিছুটা বৃষ্টি হওয়ায় কয়েকদিনের জন্য তাপমাত্রা কমলেও পরে আবার সেই আগের অবস্থায় ফিরে আসে। এমনকি গত বুধবার ১৫ বছরের মধ্যে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪৩ দশমিক ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, ২/৩ দিনের মধ্যে তাপমাত্রা কমার সম্ভাবনা নেই। তবে, বৃষ্টি হলে তাপমাত্রা কমতে পারে। তাদের মতে, এপ্রিল-মে মাস সবচেয়ে গরমের মাস। এ সময় তাপমাত্রা এ রকমই থাকে। একই সঙ্গে দু’একদিনে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলেও উল্লেখ করেন তারা। অপরদিকে গরমের কারণে ডায়রিয়া, আমাশয়, জন্ডিস ও পানিবাহিত নানা রোগবালাই বাড়ায় এ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা প্রচুর পরিমাণে পানি, স্যালাইন ও লেবুর শরবত খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
গতকাল দুপুরের দিকে রাজধানীর ফার্মগেট, আসাদ গেট, শুক্রাবাদ, পান্থপথ, বাংলামোটর, পল্টন, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়িসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে শ্রমজীবী মানুষ এবং পথের মানুষের দুর্ভোগ। মানুষকে গরমে হাঁসফাঁস করতে দেখা গেছে। গতকাল রাজধানীর পাবলিক পরিবহনগুলো অনেকটা ফাঁকা দেখা গেছে। রোদ এবং গরম থেকে যাত্রীদের একপাশে বসতে দেখা গেছে। রোদের কারণে এক পাশের সিট খালিই দেখা গেছে। গতকাল (শুক্রবার) ছুটির দিন হওয়ায় তীব্র গরমে প্রয়োজন ছাড়া মানুষ ঘরের বাইরে বের হননি। প্রয়োজনে যারা বের হয়েছেন তাদের অনেকে আবার তীব্র গরমে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য রাজধানী কনফেকশনারি ও অন্যান্য দোকানগুলোতে ভিড় করেছেন। গত প্রায় ২ মাস থেকেই রাজধানীতে শশা, তরমুজ, ডাব, শরবত ও কোমল পানীয় বিক্রির পরিমাণ বেড়ে গেছে। তবে, এ সব খাবারের দাম অনেক বৃদ্ধি পাওয়ায় তা খাওয়াও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের জন্য।
রাজধানীর শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে অনেক রিকশা চালককে গরমে ক্লান্ত হয়ে এক সঙ্গে বিশ্রাম নিতে দেখা গেছে। তৃষ্ণা মেটাতে এ সময় তাদেরকে শরবত, তরমুজসহ পানিজাতীয় খাবার কিনে খেতে দেখা গেছে। তবুও কোনভাবে মিটছে না তৃষ্ণা। অনেকে আবার গরমের কারণে ক্লান্ত হয়ে পারছেন না রিকশার প্যাডেল ঘুরাতে। তাদের কাছে যেন এক বিতৃষ্ণার গরম। রিকশাচালক হোসেন সিকদার জানান, তীব্র গরমে এক ট্রিপ মারার পর আধা ঘন্টা বসে থাকতে হয়। দুপুরের পর আর শরীরে শক্তি পাই না। ক্লান্ত অবস্থার কথা জানিয়ে বলেন, চানখারপুল থেকে শাহবাগে আসতে অবস্থা খারাপ। গরম বাড়ায় রিকসা বেশি সময় চালাতে পারছিনা। এভাবে চললে পরিবার পরিজন নিয়ে দিনাতিপাত করা কষ্ট হয়ে পড়বে বলে জানান তিনি। শুধু হোসেন শিকদার নয়; পাশে দাঁড়িয়ে বাবুল নামের আরেক রিকসা চালকও একই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন। তিনি জানান, এই গরমে এক বেলার বেশি রিকশা চালানো সম্ভব হয় না।
রাজধানীর চানখারপুলের বাসিন্দা জামাল উদ্দিন জানান, কয়েকদিন থেকে গরমের মাত্রা বাড়ায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। গরমে কাজ বন্ধ রেখে বাসায়ও থাকতে পারছিনা।
তীব্র গরমে শুধু রাজধানীর অবস্থায়ই ত্রাহি নয়; দেশের সর্বত্রই তাপমাত্রার একই অবস্থা। তাপদাহে মানুষের স্বাভাবিক জীবন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বেড়েছে অসুখ-বিসুখ। বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাবে দেশের কোনো কোনো অঞ্চল কারবালা হয়ে গেছে। আবহাওয়া অফিস বলছে, বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি থাকায় তাপমাত্রার চেয়ে একটু বেশিই গরম অনুভূত হচ্ছে এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে এ বছর বৃষ্টির সম্ভাবনা অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা কম বলেও জানান তারা। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় সারা দেশেই দেখা দিয়েছে ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ। এ মাসের শুরুতে রাজধানীসহ দেশের কয়েকটি স্থানে বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়া বইয়ে গেলে ওখানেই শেষ; এরপর আর বৃষ্টির মুখ দেখতে পায়নি সাধারণ মানুষ। বরং আরও বেড়েছে তাপমাত্রা।
গত মাসেও দেশে কয়েকদফা দাবদাহ বয়ে গেছে। দেশের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি ছিল। তখন দেশের মসজিদ, মন্দির, গির্জায় পানির জন্য প্রার্থনা করেছে মানুষ। তারপর তাপমাত্রা কিছুটা কমলেও গত ১ সপ্তাহ থেকে তা আবার অসহনীয় পর্যায়ে রয়েছে।
ঢাকার আইসিডিডিআরবি’র সূত্র মতে, কয়েকদিন বিরতির পর গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আবার বাড়ছে ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়েছে দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায়। গতকাল রাত ৮টা পর্যন্তই ৪৬৪ জন রোগী ভর্তি হয়েছে আইসিডিডিআরবিতে। গরমের তীব্রতা বাড়ায় রাত ১২টা নাগাদ রোগী সংখ্যা ৬০০ ছাড়ানোর আশংকা করা হয়।
ঢাকার আশেপাশে অন্যান্য জেলা ও উপজেলা হাসপাতালগুলোতেও ডায়রিয়ার রোগী বেড়েছে। এছাড়া খরায় ফসলের মাঠে পানি না থাকায় মাটি শুকিয়ে ফেটে যাচ্ছে। বৃষ্টি না হওয়ায় বিভিন্ন স্থানে নলকূপ থেকে পানি উঠছে না। এ দিকে বৃষ্টি না হওয়ায় পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় রাজধানী ঢাকায় শুরু হয়েছে তীব্র পানি সংকট। ওয়াসার বিভিন্ন গভীর নলকূপ থেকে প্রয়োজনীয় পানি উঠছে না।
আবহাওয়াবিদ সানাউল হক ইনকিলাবকে বলেন, বৃষ্টি হলে ২/৩ দিনের মধ্যে তাপমাত্রা কমে যাবে। অন্যথায় নয়। একই সঙ্গে রাজধানীসহ সারা দেশেই বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তিনি বলেন, এপ্রিল এবং মে মাস সবচেয়ে গরমের মাস। এই সময়ে তাপমাত্রা কিছুটা বেশি থাকে। তাই বেশি গরম অনুভূত হয়।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডা. সুফিয়া খাতুন বলেন, ডায়রিয়া ও পানি বাহিত রোগ থেকে রক্ষা পেতে হলে বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। পানি ফুটানোর সাথে ফিল্টারিং করে খেতে পারলে আরও নিরাপদ। তিনি শিশুদের বাইরের খাবার থেকে বিরত রাখার জন্য মা’দের প্রতি আহবান জানান। একই সঙ্গে ঘরের তৈরি ফ্রেশ গরম খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
আইসিডিডিআর,বি’র প্রধান মেডিকেল অফিসার ও ডায়রিয়া ইউনিটের প্রধান ড. আজহারুল ইসলাম খান বলেন, রোগীর সংখ্যা বাড়ার পেছনে তারা দূষিত পানি, অস্বাস্থ্যকর খাবার, ঘনবসতি বা বস্তি, আর্থিক অসচ্ছলতা এবং গরমকে দায়ী করেন। এর বেশির ভাগই হচ্ছে ব্যক্তিগত কারণে। এ জন্য তিনি অসচেতনতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন।
আইসিডিডিআরবি’র সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. এস এম রফিকুল ইসলাম ডায়রিয়ার সতর্কতা সম্পর্কে বলেন, ডায়রিয়া হলে শরীর থেকে পানি চলে যায় এবং গরমের কারণে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তবে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা গেলে শুধু ডায়রিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব। বারবার পাতলা পায়খানা হলে সঙ্গে সঙ্গে খাবার স্যালাইন খাওয়া শুরু করতে হবে। একই সঙ্গে তিনি এই গরমে শিশুদের বাড়তি পরিচর্যা নিতে বাবা-মাকে অনুরোধ করেন।







