চোখ জুড়ে অপার সম্ভাবনা। কিন্তু মনের কোণে জমেছে একরাশ আশঙ্কার ঘনকালো মেঘ। দীর্ঘ ৬০ বছরের চেনা সহকর্মী-সহপাঠী-প্রতিবেশী, চেনা বাস্তুভিটা, জীবিকার বাড়তি অনুষঙ্গ ছেড়ে যেতে হবে সম্পূর্ণ অচেনা, অনিশ্চিত মুলুকে। এই চিন্তায় অস্থির হাজারীবাগের চামড়া শিল্পের (ট্যানারি) শ্রমিকরা। এ শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত কয়েক লাখ পরিবারের চোখেই অনিশ্চয়তার আবছা অন্ধকার।
পরিবেশ দূষণের কারণে ট্যানারি শিল্পকে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে সাভারে একটি আলাদা শিল্প এলাকা গড়ার পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই পুরো শিল্পকে স্থানান্তর করা হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। স্থানান্তরের জন্য শিল্প মালিকদের অর্থসহায়তা দেয়ারও ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কিন্তু ট্যানারি শিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের কী হবে? এদের বেশিরভাগই এখন হয়ে গেছেন হাজারীবাগের বাসিন্দা। কেউ কেউ আবার ট্যানারিতে কাজ করার পাশাপাশি শুরু করেছেন ছোট-খাট ব্যবসা। স্থানান্তর করার সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়েছেন এই শ্রমিক পরিবারগুলো। বিশেষ করে যাদের ছেলে-মেয়েরা পড়াশুনা করে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন জায়গায় গিয়ে স্কুল, সহপাঠী আগের মতো জুটবে কি না এসব নিয়ে তাদের সংশয় রয়েছে। ট্যানারিতে কাজ করার পাশাপাশি যারা একটু বাড়তি আয়ের জন্য ছোটখাট ব্যবসা করেন তাদের কী হবে?
ছোট্ট একটি দোকান করেন ট্যানারি শ্রমিক সাত্তার। বেচাবিক্রিও বেশ ভালো। এখন এসব ছেড়ে চলে যেতে হবে সাভারে। ক্ষোভ প্রকাশ করে এই শ্রমিক বলেন, ‘১০ বছর ধরে কষ্ট করে এখানে একটা দোকান নিয়েছি। এখন শুনছি সাভারে চলে যেতে হবে। তাহলে আমার দোকানের কী হবে? তাছাড়া আমার ছেলে-মেয়েরা এখানে পড়াশুনা করে। ওখানে নতুন জায়গায় গিয়ে ওরা কীভাবে কী করবে, কিছুই বুঝছি না।’
ট্যানারির মতো ভারি শিল্পটি দীর্ঘ প্রায় ৬০ বছর ধরে হাজারীবাগে অবস্থিত। এ কারণে ট্যানারি শিল্পের সঙ্গে কাঁচা চামড়ার ব্যবসা, রাসায়নিক ব্যবসা, ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসা, মেশিন মেইনটেন্যান্স, ঠেলাগাড়ি, উপজাত (বাইপ্রোডাক্ট) প্রস্তুতকারী ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে পড়েছে।
অবশ্য ট্যানারিগুলো অপরিকল্পিত ভাবে গড়ে উঠেছে। চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার সময় বের হওয়া উচ্ছিষ্টের দূষণে জর্জরিত গোটা হাজারীবাগ এলাকা। এর মধ্যেই বসবাস করে ১৫ থেকে ২০ লাখ মানুষ যারা ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। এখানে নেই উন্নত নালা ব্যবস্থাপনা। বর্জ্য ও রাসায়নিক মিশ্রিত পানি শোধনের ব্যবস্থাও (ইটিপি) নেই বেশিরভাগ ট্যানারিতে। ট্যানারির বিষাক্ত পানি সরাসরি গিয়ে পড়ছে নদীতে। শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু ও বুড়িগঙ্গার ১১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ব্যাপকভাবে দূষিত হচ্ছে।
আর এ কারণেই শিল্পটিকে সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কিন্তু এ শিল্পে সঙ্গে যেসব খেটে খাওয়া মানুষের জীবন জীবিকা ওতপ্রোতভাবে জড়িত তাদের যেনো কোনো ক্ষতি না সেদিকটি কতোটা নিশ্চিত করা হচ্ছে সেটিই দেখার বিষয়।
দীর্ঘদিন ধরে ট্যানারি শিল্পের দেখভাল করছেন ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস এমপি। শ্রমিক ও মালিকদের সুখে-দুঃখে পাশে থাকেন তিনি। কিন্তু এই শিল্প নতুন ঠিকানায় গেলে শ্রমিক ও মালিকদের কী হবে। তিনি কি থাকবেন তাদের সঙ্গে ঠিক যেমনটি আছেন!
এসব নিয়ে কথা হলে ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘আগেইতো তাদের সাভারে পাঠানো যাবে না। প্রথমে ওখানে গিয়ে আমরা দেখবো। তারপর যদি দেখি যে শ্রমিক ও মালিকদের জন্য ওখানে সকল সুব্যবস্থা আছে তাহলেতো আর ওখানে যেতে ওদের সমস্যা থাকাবে না। তাছাড়া সাভারতো আর বেশি দূরে না। তারা যদি আমায় স্মরণ করে তাহলে অবশ্যই আমাকে তারা যে কোনো সমস্যায় কাছে পাবে।’
চলমান স্থানান্তর প্রক্রিয়ার বর্তমান পরিস্থিতিতে হাজারীবাগ ট্যানারিগুলোকে পরিবেশবান্ধব ও সুপরিকল্পিতভাবে স্থানান্তরের জন্য বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) পক্ষ হতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বেশ কিছু দাবিও ইতিপূর্বে তুলে ধরা হয়েছে। ঠিক তারই ভিত্তিতে সাভারে তৈরি করা হচ্ছে ট্যানারি শিল্পের নতুন ঠিকানা।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহম্মেদ বলেন, ‘ট্যানারি শিল্পে যত ধরনের সুবিধা প্রয়োজন তার সবটাই ওখানে (সাভারে) রয়েছে। তারপরও যদি আরো কোনো কিছুর ব্যবস্থা করা লাগে সেটাও করা হবে। তবে একবারে কিছুই সম্ভব না। একটুতো অপেক্ষা করতেই হবে। তাছাড়া ওখানে তো স্কুল, কলেজ, আধুনিক স্বাস্থকেন্দ্রসহ সকল সুবিধা রয়েছেই।’
তবে যাইহোক, হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্পকে একটি নিরাপদ স্থানে স্থানান্তরের কোনো বিকল্প নেই। ঢাকা আশেপাশের নদী ও পরিবেশকে বাঁচাতে হলে এটা করতেই হবে। কিন্তু এই স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় যাতে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের জীবিকা নিশ্চিত হয় এবং স্থানান্তরজনিত কোনো সমস্যায় তারা না পড়ে এটাই সবার কাম্য।