গুলি করে, পুড়িয়ে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হককে নৃশংসভাবে হত্যার জন্য ফেনী-২ আসনের সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীকে দায়ী করেছেন নিহতের কর্মী-সমর্থকেরা৷ তবে ঘটনার জন্য বিএনপির এক নেতাসহ ৩৬ জনের বিরুদ্ধে ফেনী থানায় মামলা করেছেন নিহতের ভাই রেজাউল হক ওরফে জসিম।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পুলিশ ১৫ জনকে ‘সন্দেহবশত’ গ্রেপ্তার করেছে৷ একজন বাদে এঁদের সবার বয়স ১৮ থেকে ২৫-এর মধ্যে। জেলা শহর থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে একটি কার ও দুটি মোটরসাইকেল৷ এগুলো হত্যায় ব্যবহৃত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ এ হত্যার প্রতিবাদে আজ বৃহস্পতিবার ফুলগাজী উপজেলায় হরতাল ডেকেছে উপজেলা আওয়ামী লীগ৷
দিনভর শোক, বিক্ষোভের মধ্যে তিন দফা জানাজা শেষে একরামুল হককে গতকাল বন্দুয়া দৌলতপুর গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। এরপর একরামের বিক্ষুব্ধ সমর্থকেরা ফেনী-ফুলগাজী-পরশুরাম সড়কে একটি বেইলি সেতুর (বন্দুয়া পুল) পাটাতন খুলে ফেলে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। তাঁরা কয়েকটি যানবাহনও ভাঙচুর করেন। বিক্ষুব্ধরা এ সময় হত্যাকাণ্ডের জন্য নিজাম উদ্দিন হাজারীকে দায়ী করে তাঁর বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। ‘একরাম ভাই মরল কেন, নিজাম হাজারীর ফাঁসি চাই’সহ নানা স্লোগান দেন তাঁরা৷ বিভিন্ন গণমাধ্যমের কাছেও তাঁরা হত্যাকাণ্ডের জন্য নিজাম হাজারী দায়ী বলে মন্তব্য করেন৷
তবে নিজাম হাজারী দলের ভেতরে কোনো কোন্দল নেই বলে দাবি করেন। তিনি ঘটনার জন্য একরামের নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির নেতা মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীকে দায়ী করেন। তবে তদন্তে যারাই চিহ্নিত হোক, তাদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানানো হয়। নিজের অবস্থান ব্যাখ্যার জন্য আজ দুপুরে স্থানীয় একটি রেস্তোরাঁয় সংবাদ সম্মেলন করবেন নিজাম হাজারী৷
গত মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে ফেনী শহরের একাডেমি এলাকায় ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হককে বহনকারী গাড়ি থামিয়ে গুলি করে, কুপিয়ে ও শেষে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। গাড়ির ভেতরেই পুড়ে মারা যান একরামুল। মঙ্গলবার রাত একটার দিকে তাঁর বড় ভাই রেজাউল হক ফেনী থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় জেলা তাঁতী দলের আহ্বায়ক ও উপজেলা নির্বাচনে (একরামুলের বিপক্ষে) বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীর নাম উল্লেখ করে আরও ৩৫ জনকে ‘অজ্ঞাত’ আসামি করা হয়। এরপর পুলিশ ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করে। এঁরা হচ্ছেন: ইকবাল হোসেন (২২), শেখ আহম্মদ শিমুল (২৬), মো. রাজীব (২০), মো. গনি (২৫), মো. রিয়াজ (১৮), কোরবান আলী শাকিল (১৮), আনোয়ার হোসেন (২০), ছালে আহাম্মদ (৪০), আমজাদ হোসেন রুবেল (২১), মহি উদ্দিন বাবু (২১), মো. মাসুম (২৫), শাখাওয়াত হোসেন (২৪), মো. রাশেদ (২১), নুরুল করিম নাঈম (২০) ও মো. শাকিল (২০)৷
হত্যাকাণ্ডের পর মঙ্গলবার বিকেলে ঘটনাস্থলের পাশ থেকে একটি নম্বরবিহীন মোটরসাইকেল এবং রাতে বিরিঞ্চি এলাকা থেকে একটি লাল রঙের কার (চট্ট-মেট্রো-প-১১-০০১৬) ও আরেকটি মোটরসাইকেল (ফেনী-হ-১১-৩৬০৯) পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। ফেনী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহাবুব মোর্শেদ জানিয়েছেন, এই যানবাহনগুলো হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়েছে। আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
ফেনীর পুলিশ সুপার পরিতোষ ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, মামলার তদন্তে যথেষ্ট অগ্রগতি রয়েছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ঘটনার ক্লু উদ্ঘাটন সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন৷
এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় ফুলগাজী হাইস্কুল মাঠে একরামুল হত্যার প্রতিবাদে সমাবেশ করেছে উপজেলা আওয়ামী লীগ৷ সমাবেশ থেকে আজ ফুলগাজীতে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকা হয়৷
‘পরিকল্পিত হত্যা’ বললেন ওবায়দুল কাদের: গতকাল সকাল নয়টায় ফেনীর মিজান ময়দানে, সাড়ে ১১টায় ফুলগাজী পাইলট হাইস্কুল মাঠে এবং সাড়ে ১১টায় বন্দুয়া দৌলতপুর গ্রামে তৃতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে চেয়ারম্যান একরামুল হকের লাশ দাফন করা হয়৷
জানাজায় যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, ফেনী-৩ আসনের সাংসদ রহিম উল্যাহ, ফেনী-১ আসনের সাংসদ ও জাসদের কেন্দ্রীয় নেত্রী শিরিন আক্তার, নারী সাংসদ জাহানারা বেগম সুরমা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দিন চৌধুরী নাসিমসহ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এটি একটি পরিকল্পিত ও ঠান্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড৷ এটি মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়৷ খুনি যে-ই হোক, তাকে ছাড়া হবে না। এ মুহূর্তে কারও ওপর দায় চাপাতে চাই না।’ বিএনপির নেতা মির্জা ফখরুল ইসলামের নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যাবে না। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, কিবরিয়া হত্যা, আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যার পরও বিএনপির নেতারা অনেক আজগুবি কথা বলেছিলেন। তদন্তে সব বেরিয়ে এসেছে। ফেনীতেও তদন্তে প্রকৃত খুনিদের শনাক্ত করা কঠিন হবে না।’
যোগাযোগমন্ত্রী আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জের সাত হত্যাকাণ্ড এবং ফেনীর একরাম চেয়ারম্যান হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন।’
প্রকাশ্য দিবালোকে বেলা ১১টায় এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, হত্যার ঘটনার আগে থেকে ৪০-৫০ জন সন্ত্রাসী শহরের একাডেমি এলাকার বিলাসী সিনেমা হলের সামনে জড়ো হয়। হত্যাকাণ্ডের পর তারা পূর্ব দিকের সড়কসহ বিভিন্ন সড়কে ভাগ হয়ে দ্রুত চলে যায়।
কেন্দ্রীয় ও জেলা বিএনপি এ হত্যার কারণ আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফল বলে দাবি করেন৷ আর আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপির ওপর দায় চাপাতে চাইছেন।