গরুর নামে মহিষের মাংস-২ মাংসে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি, হতে পারে যৌনরোগ

0
144
Print Friendly, PDF & Email

মাংস কী গরুর না মহিষের’ এমন প্রশ্ন দোকানীকে করলে এককথায় উত্তর ‘নির্ভেজাল গরুর মাংস’। আর সাধারণ মানুষ বলেন ‘ঢাকায় সবই মহিষের মাংস, বিক্রি হচ্ছে গরুর নামে’। দ্বিমুখী উত্তরে দ্বিধা বাড়ে, আরো প্রশ্ন জাগে। কিন্তু প্রমাণ পাওয়া যায় না কোথাও। কেউ জানাতে পারেন না, মহিষ থেকে গরুর মাংস হওয়ার মূল ঘটনা। তাহলে রহস্য কোথায়? বাংলামেইলের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। ঢাকায় কোত্থেকে আমদানি হয় মহিষ, কোথায় জবাই হয় এগুলো আবার কোথা থেকে বেরিয়ে আসে ‘নির্ভেজাল’ গরুর মাংস হয়ে। তিন পর্বের এ প্রতিবেদনটি সাজানো হয়েছে ‘মহিষ থেকে গরুর মাংস’ হওয়ার আদ্যোপান্ত নিয়ে। সেই সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে ‘কেঁচু খুঁড়তে গিয়ে সাপ পাওয়ার’ মতো চমকে যাওয়া অনেক তথ্য। আজ প্রকাশিত হচ্ছে দ্বিতীয় পর্ব। লিখেছেন বাংলামেইলের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট মুনিফ আম্মার।

কসাইখানায় জবাইয়ের জন্য মহিষ ঢোকানো হলেও সকালে সেগুলো বের হয় গরুর মাংস হয়ে। তরতাজা এ মাংস পাইকারী দরে কিনে নিয়ে বিক্রি করেন খুচরা বিক্রেতারা। দোকানে ঝুলিয়ে রাখেন গরুর মাংস বলেই। তাতে এমন আর অসুবিধা কী? গরু বলে না হয় মহিষের মাংসই খাওয়া হলো! কিন্তু অসুবিধা অন্য জায়গায়। কোথায়, কোন প্রক্রিয়ায় এসব পশু জবাই হচ্ছে সে ঘটনাও জানা দরকার।

কসাইখানা না ডাস্টবিন?
কাওরান বাজার কসাইখানা। গোবর, রক্তে চারপাশ কাদাকার। গন্ধে ভেতরে যাওয়া দুষ্কর। দেখে মনে হবে এটা কোনো নর্দমা। এসবের ওপরেই জবাই হচ্ছে মহিষ। সারা গায়ে লেপ্টে যাচ্ছে দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা। কিন্তু কার খেয়াল আছে সেদিকে? পরিবেশ যতোই অস্বাস্থ্যকর হোক, তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই কারও। স্বল্প সময়ে কতো বেশি মহিষ জবাই করা যাবে, সে ধান্ধায় যেনো ব্যস্ত সবাই।

কাওরান বাজারের কসাই হাজী মো. টিপু সুলতান বলেন, ‘এসব ময়লা তো থাকবো না। ধুইলেই সব ঠিক হইয়া যাইবো। মহিষ জবাই করলে তো রক্ত বাইর হইবোই। পানি দিলেই সব ফিনিশ।’

কসাইদের কাছে এমন পরিবেশ যেন কোনো ব্যাপারই না। চারপাশে মাছি ওড়া, ঘিন ঘিন করা এ পরিবেশ থেকে যে অনেক রোগ-জীবানু ছড়াতে পারে, সে চিন্তাও নেই কারো।

কসাইখানাও যখন ‘অবৈধ’
ঢাকা সিটি করপোরেশনের নিয়মানুযায়ী গরু-মহিষ বা এ জাতীয় কোনো প্রাণী জবাই করতে হলে অনুমোদিত কসাইখানায় তা করতে হবে। এজন্য উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে অনুমোদিত কসাইখানাও আছে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অনুমোদিত দু’টি কসাইখানা হচ্ছে- কাপ্তান বাজার ও হাজারীবাগ। উত্তর সিটিতে অনুমোদিত কসাইখানাও দু’টি। এগুলো হচ্ছে- মোহাম্মদপুর, মিরপুর-১১। তবে উত্তরে আরো দু’টি কসাইখানা চালু ছিল। বর্তমানে সেগুলো বন্ধ আছে বলে জানান উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রি. জে. একেএম মাসুদ।

তবে এ চারটির বাইরেও এখন গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি অবৈধ কসাইখানা। স্থানীয় প্রভাবশালীরা এসব কসাইখানা পরিচালনা করছেন। এরমধ্যে কাওরান বাজার কসাইখানাটিও অনুমোদনহীন। এছাড়া কল্যাণপুর ও উত্তরায় অনুমোদনহীন কসাইখানা রয়েছে।

কাওরান বাজার কসাইখানাটি স্থানীয় বাজার কর্তৃপক্ষ চালাচ্ছে বলে জানা গেছে। এজন্য তারা ‘ম্যানেজ’ করেছে সিটি করপোরেশনের কয়েকজন কর্মকর্তাকে। দিতে হয়েছে ‘মোটা অঙ্কের অর্থ’। আর তাই নিয়মতান্ত্রিকতার বালাই নেই এ কসাইখানায়।

জবাইতেও গলদ, যাচ্ছে তাই অবস্থা
কসাইখানাগুলোতে সিটি করপোরেশন নির্ধারিত ‘হুজুর’ দিয়ে পশু জবাই করার কথা থাকলেও কসাইরাই যেন একাই একশ। কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে কসাইরা নিজেই ছুরি চালায় পশুর গলায়। এসময় তারা কোনো ধর্মীয় রীতিও মানে না।

কাওরান বাজার কসাইখানায় গত মঙ্গলবার ভোর রাত ৪টা ২০ মিনিটে জবাই হয় সর্বশেষ মহিষটি। সে সময় কোনো হুজুরকে সেখানে দেখা যায়নি। কসাই সেলিমই হুজুরের কাজটি সেরে ফেললেন। প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘এ সময় হুজুর পামু কই?’

কিন্তু সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, নামে হুজুর থাকলেও তাদের পাওয়া যায় না কখনো। মাঝে মাঝে ‘ডুমুরের ফুলের মতো’ উঁকি দেন তারা। বাকি সব সময় কসাইরাই পশু জবাইয়ের কাজ সারেন।

এছাড়াও প্রতিটি কসাইখানায় জবাইয়ের আগে পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার নিয়ম থাকলেও বাস্তবে সেটা করতে দেখা যায়নি। দেখা যায়নি জবাইয়ের পর ‘গরু না মহিষ’ সে অনুযায়ী পশুর গালে সিল মেরে দেয়ার কাউকেও। এমনকি সিটি করপোরেশন থেকে নির্ধারিত কর আদায়ের কারো খোঁজ মেলেনি কসাইখানা।

এ চিত্র শুধু কাওরান বাজারে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর সব কসাইখানার অবস্থা একই। সিটি করপোরেশনের লোকজনের সঙ্গে যোগসাজসে কসাইখানার লোকজনই সব করছে। কেবল সময়মতো হুজুর, পরিদর্শকসহ সবার খাতে চলে যাচ্ছে নির্ধারিত অর্থ।

প্রতিটি গরুর জন্য ৫০ টাকা, মহিষের জন্য ৭৫ টাকা ও ছাগলের জন্য ১০ টাকা হারে সিটি করপোরেশনের ফান্ডে জমা দেয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু তদারকি না থাকায় সে টাকাও ঠিকমতো যাচ্ছে না কোষাগারে। বছরে কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

মাংসে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি, হতে পারে যৌনরোগও
অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশে পশু জবাইয়ের ফলে এর মাংস মারাত্মকভাবে স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। এসব মাংস খেয়ে চর্ম, যক্ষ্মা থেকে শুরু করে যৌনরোগের মতো ভয়াবহ ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মুরাদ হোসেন বাংলামেইলকে বলেন, ‘পশু থেকে মানবদেহে নানা রোগ ছড়াতে পারে। অসুস্থ পশুর মাংস খেলে যক্ষ্মা থেকে শুরু করে ব্রুসেওলসিস নামক যৌনরোগও হতে পারে। এমনকি পশুর শরীরে অ্যানথ্রাক্স থাকলেও সে রোগও ঢুকে যেতে পারে মানবদেহে।’

সিটি করপোরেশন যা বলছে
এসব অনিয়ম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহ আর হারুন বলেন, ‘আমাদের দুটি কসাইখানা আছে। এগুলোতে আমার জানা মতে সবকিছুই ঠিকঠাক মতো হচ্ছে। তবে আপনি যেহেতু বলেছেন, সেজন্য আমি আবার খোঁজ-খবর নিচ্ছি। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

তবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম মাসুদ সঠিকভাবে কিছু জানাতে পারেননি। এমনকি তার আওতাধীন কয়টি কসাইখানা আছে সেটাও ঠিকমতো বলতে পারেননি তিনি। মাসুদ বলেন, ‘আগে তো চারটা ছিল। এখন হয়তো দুইটা কসাইখানা চালু আছে।’ সেগুলোর ঠিকানাও তিনি বলতে পারেননি।

কাওরান বাজার কসাইখানা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা প্রথমে এটিকে দক্ষিণ সিটির আওতাধীন বলে জানান। পরে অবশ্য বলেন, ‘কাওরান বাজারে যদি কসাইখানা হয়েই থাকে, তাহলে সেটাকে সিটি করপোরেশনের রেগুলেশনের মধ্যে নিয়ে আসবো।’

পর্ব-১: অবৈধ উপায়ে সীমান্ত পার, ৫২০ টাকায় বৈধতা
[রাতভর জবাই হওয়া মহিষগুলো সকালে কীভাবে গরু হয়ে বের হয়, সে ঘটনা জানবেন আগামী পর্বে। সঙ্গে থাকবে মাংসের খুচরা দোকান, হোটেল কিংবা রেস্টুরেন্টে ক্রেতাদের সঙ্গে মাংস নিয়ে প্রতারণার গল্পও।]

শেয়ার করুন