শেষ দফা নির্বাচনেও নগ্ন ভোটডাকাতি

0
125
Print Friendly, PDF & Email

কুমিল্লার ধনুয়াখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার একাই শত শত ব্যালটে জালভোট দিয়ে বাক্সে ঢোকানোর দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দী করেন আমাদের সিনিয়র ফটো সাংবাদিক নাসিম সিকদার
ব্যাপক ভোট কারচুপি, কেন্দ্র দখল, পোলিং এজেন্টদের মারধর, জালভোট প্রদান, নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে ষষ্ঠ ও শেষ দফা উপজেলা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় কেন্দ্র দখলকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধসহ হতাহতের খবর পাওয়া গেছে। জালভোট দেয়ার অপরাধে বেশ কয়েকজনকে কারাদণ্ড ও জরিমানা করা হয়। ব্যাপক জালভোট ও কেন্দ্র দখলের অভিযোগ এনে বিভিন্ন জায়গায় নির্বাচন বর্জন করে নতুন করে ভোটগ্রহণের দাবি জানিয়েছেন অনেক প্রার্থী।
কুমিল্লা : কুমিল্লা আদর্শ সদর ও সদর দণি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। ককটেল বিস্ফোরণ, গুলি, কেন্দ্র দখল, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা, প্রিজাইডিং অফিসারকে মারধর, ব্যালট পেপার ছিনতাইসহ হেন অপকর্ম নেই যা ঘটেনি। আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীর কর্মী আনোয়ার হোসেন নামে একজনকে ৯টি ব্যালট পেপারসহ আটক করে ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান এবং ওই কেন্দ্রে একই প্রার্থীর ভুয়া এজেন্ট আবু নাসের নামে একজনকে আটক করে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেন কুমিল্লার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো: শফিকুল ইসলাম।
কুমিল্লা সদর উপজেলার ২ নম্বর দুর্গাপুর (উত্তর) ইউনিয়নের আলেকজান মেমোরিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নারী ভোটকেন্দ্র থেকে একটি দেশী পিস্তল ও চার রাউন্ড গুলিসহ ছাত্রলীগের তিন ক্যাডারকে আটক করেছে পুলিশ। এ সময় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ছোড়া গুলিতে সালাউদ্দিন নামে বিএনপির এক কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে স্থানীয় বিএনপি দাবি করেছে। তাকে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আটককৃতরা হলেন ছাত্রলীগ ক্যাডার জয়নাল আবেদিন (২৫), মনির (২৪) ও আব্দুল ওয়াদুদ।
জেলার আদর্শ সদর উপজেলার সুবর্ণপুর ভোটকেন্দ্রে সকাল ১০টার দিকে ৬০০ ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া বামইল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ককটেল বিস্ফোরণসহ জালভোট প্রদান করা হয়। এ সময় আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীর কর্মী আনোয়ার হোসেনকে (৩০) ৯টি ব্যালট পেপারসহ আটক করে ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয় এবং ওই কেন্দ্রে একই প্রার্থীর ভুয়া এজেন্ট আবু নাসেরকে (২৮) আটক করে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেন কুমিল্লার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো: শফিকুল ইসলাম। রতœাবতী আদর্শ বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে চেয়ারম্যান প্রতীকের দুইটি বই ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। উপজেলার মাঝিগাছা আক্তারুজ্জামান উচ্চবিদ্যালয়, বামইল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে জালভোট প্রদান করা হয়। ধর্মপুর কেন্দ্রসহ বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে ককটেল বিস্ফোরণ ও ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় কমপে চারজন আহত হয়। সকাল ১০টার দিকে দৌলতপুর ছায়া বিতান প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসারকে মারধর করে ৬০০ ব্যালট পেপার ছিনতাই করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
১৯ দল সমর্থিত বিএনপি দলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থী ফজলুল হক ফজলু জানান, তার প্রতিপ আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর কর্মীরা বেশির ভাগ কেন্দ্র দখল করে নিয়েছে। ভোটারদের হুমকি প্রদর্শন ও কেন্দ্রে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেও কোনো কাজ হয়নি। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা রাশেদুল ইসলাম জানান, ককটেল বিস্ফোরণ ও সংঘর্ষের কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় দৌলতপুর ছায়াবিতান প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আফজল খান কমার্স কলেজসহ দুইটি কেন্দ্রে কিছু সময় ভোট গ্রহণ স্থগিত রাখা হয়েছিল।
জেলার সদর দণি উপজেলার পিপুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশ আট রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কর্মী- সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় বিএনপির দুই কর্মী গুলিবিদ্ধ হন। আলীশ্বর কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ ও ঐক্য সংহতি পরিষদ সমর্থিত বিএনপি দলীয় প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়।
বিজয়নগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) : ব্যাপক ভোট কারচুপি, কেন্দ্র দখল, পোলিং এজেন্টদের মারধর, জালভোট প্রদান, নির্বাচন বর্জনের মধ্য ষষ্ঠ দফা উপজেলা নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবগঠিত বিজয়নগর উপজেলা নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হয়েছে। বিভিন্ন কেন্দ্রে সকাল থেকেই ভোটার উপস্থিতি খুবই কম ছিল। বেলা বাড়ার সাথে সাথে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর সমর্থকেরা বিভিন্ন কেন্দ্র দখল করতে শুরু করে। সকালে চরইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে অনিয়মের তথ্য দেয়ায় এনএসআই’র এক সদস্য লাঞ্ছিত করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বশিরুল হক ভূঁইয়া। এ দিকে খাদুরাইল কেন্দ্র থেকে পাঁচটি মোবাইল সেট জব্দ করেছে সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। দুপুর পর্যন্ত ভোট চলাকালে উপজেলার বড় পুকুরপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র, আলাকপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বোয়ালখলা প্রাথমিক বিদ্যালয়, মোহাম্মদপুর মাদরাসা কেন্দ্র, আদমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চরইসলামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়, বিষ্ণুপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সাতগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়, আবদুল্লাহপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কেনা দখিল মাদরাসা, আরিয়ল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মেঘশিমূল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ কমপে ৩০টি ভোটকেন্দ্র দখল করে। জেলা জাতীয় ছাত্রসমাজের সাধারণ সম্পাদক কে এম সুজন অভিযোগ করেন, আওয়ামী সমর্থক প্রার্থী তানভীর ভূঁইয়ার পক্ষে তার আত্মীয়স্বজন এবং আওয়ামী লীগের লোকজন বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে জোরপূর্বক এজেন্টদের মারধর করে বের করে দিয়ে কেন্দ্র দখল নিয়ে জালভোট দেয়ার মহোৎসব চালায়। কেন্দ্রে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা নীরব ভূমিকা পালন করেন। দুপুরে ছতুরপুর কেন্দ্র দখল করে সরকারদলীয় সমথ কেরা জালভোট প্রদানের অভিযোগ করেছেন জামায়াত সমর্থিত ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী আলী নেওয়াজ। এই কেন্দ্রে বেলা ১১টায় কেন্দ্র দখল করে ৬ শ’ জাল ভোট দেয় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর লোকজন। বেলা ২টার পর উপজেলার অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রে জালভোট প্রদানের মহোৎসব শুরু হয়।
কামারখন্দ (সিরাজগঞ্জ) : সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন চলাকালে জালভোট দেয়ার অপরাধে তিনজনকে আটক করা হয়েছে। আটককৃতরা হলো, জামতৈল দক্ষিণ পাড়া গ্রামের আব্দুল আলিমের ছেলে ফয়সাল আহমদ নাইম, ভদ্রঘাট কুটির চর গ্রামের হাফিজুর রহমানের ছেলে জয় সরকার ও একই গ্রামের আব্দুল মান্নানের ছেলে সাব্বির আহমদ। জামতৈল মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ৯টি ব্যালট বই জব্দ করা হয়। এ ঘটনার পর এই কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে আধঘণ্টা পর আবার ভোটগ্রহণ শুরু হয়।
গতকাল বেলা ১১টার দিকে এই কেন্দ্র পরিদর্শনে আসেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার ইশরাত ফারজানা। এ সময় তিনি জালভোট দেয়ার সময় হাতেনাতে কিশোর নাইমকে আটক করেন। তিনি ওই বুথ থেকে সিলমারা ৯ শ’ ব্যালট পেপার উদ্ধার করেন।
এ দিকে দুপুর ১২টার দিকে ভদ্রঘাট কুটিরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে জালভোট দেয়ার অপরাধে দু’জনকে আটক করেছে পুলিশ।
এ দিকে নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। বিকেলে উপজেলা বিএনপি কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি সমর্থিত প্রাথী অধ্য আব্দুল আজিজ সরকার বলেন, ব্যাপক কারচুপি, এজেন্ট বের করে দিয়ে ইচ্ছেমতো ভোট কেটে নেয়া হয়েছে। সেই সাথে তার ভাই, স্ত্রীসহ দলীয় নেতাকর্মীদের লাঞ্ছিত করা হয়। যে কারণে তিনি ভোট বর্জন করে নতুনভাবে ভোটগ্রহণের দাবি জানান।
কালুখালী (রাজবাড়ী) : রাজবাড়ীর নবগঠিত কালুখালী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হয়েছে। সকাল থেকেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাজী সাইফুল ইসলামের আনারস প্রতীকের সমর্থকেরা সব প্রার্থীর এজেন্ট ও কর্মীদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়। পরে ভোটারদের ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে তাতে কাজী সাইফুল ইসলামের কর্মী আনারস প্রতীকের সিল মেরে ব্যালট বাক্সে রেখে দেয়। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত কালুখালী মদাপুর ইউপির গড়িয়ানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে এ ঘটনা চললেও প্রশাসন ছিল নীরব দর্শক। কেন্দ্রটির প্রিজাইটিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করছেন কালুখালী সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার ফজলুল হক। তিনি জানান, এ কেন্দ্রের মোট ভোটার ৩ হাজার ১৯৯ জন। এদের অর্ধেক ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। তবে ভোটারদের অভিযোগ, তারা ভোট দিতে পারেননি। এ ছাড়া প্রার্থী কাজী সাইফুল ইসলামের কর্মীরা মদাপুরের ধুবাড়ীয়া, গোপালপুর ও গোয়ালপাড়া এলাকার কেন্দ্র দখল করে ভোট কেটে নিয়েছে। ভোট কাটার প্রস্তুতি চলছিল মদাপুরের দুর্গাপুর স্কুল কেন্দ্রে। রতনদিয়ার মহেন্দ্রপুর ও পশ্চিম হরিনবাড়ীয়া এলাকায় ভোটারদের ভয়ভীতি দেখিয়ে কেন্দ্রে আসতে দিচ্ছে না। এ দিকে কালুখালীর সাওরাইল ইউনিয়নের বিকয়া এলাকায় চলছে হাসুয়া ও রামদা নিয়ে অস্ত্রের মহড়া। দুপুরে যুবদল নেতা সাজাহান আলী বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী রাজ্জাক খানকে ভোট দিতে এলে কাজী সাইফুল ইসলামের কর্মীরা তাকে মারধর করে গুরুতর আহত করে। এ ছাড়া কৃষকলীগ সমর্থিত প্রার্থী নুরে আলম সিদ্দিকী হকের পক্ষে মসলেম মণ্ডল ভোট দিতে গেলে তাকেও কুপিয়ে আহত করে। ফলে সাইফুল ইসলামের বিপক্ষের কোনো ভোটার কেন্দ্রে যাননি। আহত শাজাহান আলী জানান, প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্ট বের করে দিয়ে ওই কেন্দ্র থেকে কাজী সাইফুল ইসলামের কর্মীরা আনারস প্রতীকে ভোট কেটে নিচ্ছে। বড় সাওরাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে হামলা চালায়। জামালপুর কেন্দ্রে প্রকাশ্য ভোট নেয়ায় ভ্রাম্যমাণ আদালত সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার হাবিবুর রহমানকে দুই হাজার টাকা ও দুই পোলিং অফিসারকে দুই হাজার টাকা জরিমানা করেন। আখরজানি কেন্দ্রে ভ্রাম্যমাণ আদালত আবুল কালাম আজাদ নামে একজনকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করেন। সেখানে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ও ব্যালট ছিনতাইয়ের অভিযোগ উঠেছে। আবুল কালাম আজাদ ও জাহাঙ্গীর আলম নামে মোটরসাইকেলের দুই সমর্থককে মারধরের অভিযোগ উঠেছে।
জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক জনতার আদালত পত্রিকার সম্পাদক নুরে আলম সিদ্দিকী হক জানান, সাওরাইল ইউনিয়নের বিষে সাওরাইল, বড় সাওরাইল, জামালপুর, বিকয়া, মাজবাড়ী ইউনিয়নের বেতবাড়িয়া, হাড়িভাঙ্গা, মাজবাড়ী, কুলটিয়া, মোহনপুর, মদাপুর ইউনিয়নের গড়িয়ানা, গোপালপুর, গোয়ালপাড়া, ধুবাড়ীয়া, দামুকদিয়া, কালিকাপুর ইউনিয়নের মৌকুড়ি, রায়নগর, বোয়ালিয়া, খাকজানা, হামরাট ও মৃগী ইউনিয়নের আখরজানী কেন্দ্রে এজেন্টদের জোরপূর্বক কেন্দ্র থেকে বের করে দেয় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী কাজী সাইফুল ইসলামের লোকজন। তিনি নির্বাচন স্থগিতের দাবি জানান।
তালতলী (বরগুনা) : কারচুপি, কেন্দ্র দখল ও প্রশাসনিক সহায়তায় ভোট ডাকাতির অভিযোগ এনে বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বী তিনজন প্রার্থীর দু’জনেই ভোট বর্জন করেছেন। দুপুর ১২টার দিকে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিএনপি সমর্থিত অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ তালুকদার ও বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী ফরহাদ হোসেন আক্কাস মৃধা ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। ওই দুই প্রার্থীর অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী মনিরুজ্জামান মিন্টু ও তার সমর্থকেরা বিভিন্ন কেন্দ্র প্রশাসনের সহায়তায় দখলে নিয়ে এজেন্টদের বের করে দিয়ে ভোট কারচুপি করেছেন।
সকাল ৮টায় যথারীতি ২৯টি কেন্দ্রে একযোগে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। নবগঠিত উপজেলায় প্রথমবারের মতো ভোটারদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। সকাল সাড়ে ৮টা থেকেই পরবর্তী এক ঘণ্টা বুথগুলোতে পুরুষ ও নারী ভোটারদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আলীরবন্দর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে প্রকাশ্যে ভোট দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় তৈয়ব আলী (৪৩) ও নুরুল ইসলাম (৬৫) নামে দুই ভোটারকে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সমর্থকেরা মারধর করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সকাল ১০টার দিকে গাবতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনিরুজ্জামান মিন্টু তার সমর্থকদের নিয়ে কেন্দ্রে ঢুকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেন। পরে তারা ব্যালটে সিল দেন। খবর পেয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরা ওই কেন্দ্রে ঢুকতে চাইলে আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা তাদের বাধা দেন। এ সময় তারা একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। ভোটাররা অভিযোগ করেছেন, জাকিরতবক দাখিল মাদরাসা, বেহালা মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নলবুনিয়া সাইকোন শেল্টার, হরিণখোলা দাখিল মাদরাসা, দক্ষিণ সওদাগারপাড়াসহ ২০টিরও বেশি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সমর্থকেরা ভেতরে ঢুকে প্রকাশ্যে ভোট দিতে বাধ্য করছেন।
বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ তালুকদার অভিযোগ করে বলেন, প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহায়তায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী নিজে ও তার সমর্থকেরা কেন্দ্র থেকে আমার এজেন্টদের বের করে দিয়ে ইচ্ছেমতো ব্যালটে সিল দিয়ে বাক্সে পুরেছেন। বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী ফরহাদ হোসেন অভিযোগ করেন, ভোট নেয়া শুরু হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থক ও এজেন্টরা সব কেন্দ্র থেকে তার এজেন্টদের বের করে দিয়ে ব্যালট ছিনিয়ে নিয়ে সিল দেন।
বেলা ১টার দিকে প্রায় সব কেন্দ্র আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দখলে নিয়ে ইচ্ছেমতো ভোট ডাকাতি করে। প্রশাসনের সামনে প্রকাশ্য সিল মেরে বাক্স ভরলেও তারা নীরব ভূমিকা পালন করছে। তার নেতাকর্মীদের মারধর, ভোটকেন্দ্র আসতে বাধা দেয়ার অভিযোগ করলে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। জাকিরতবক কেন্দ্রে তার কর্মী সাগর ও সাগরের বাবাকে পিটিয়ে আহত করছে। সরকারদলীয় প্রার্থীর সমর্থকরা। এ ছাড়া প্রতিটি কেন্দ্রে তার নেতাকর্মীদের ওপর মারধর ও নির্যাতন করার অভিযোগও করেন। এ দিকে নির্বাচন বর্জনের খবরের পর কেন্দ্রগুলোতে কোনো ভোটার উপস্থিত হননি।
রংপুর : জালভোট, পদে পদে আচরণবিধি লঙ্ঘন, প্রার্থীর ছবি ও প্রতীকসংবলিত স্লিপের ব্যবহার, চেয়ারম্যান প্রার্থী, ছাত্রলীগ নেতা গ্রেফতার, বিজিবি প্রার্থীর হট্টগোল, কেন্দ্রের বাইরে দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, সরকারদলীয় প্রার্থীর সমর্থক কর্তৃক এজেন্ট বের করে দেয়াসহ বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে সোমবার টানা আট ঘণ্টা ভোটগ্রহণ হয়েছে রংপুরের সদর, পীরগাছা, কাউনিয়া ও গঙ্গাচড়া উপজেলায়। তবে প্রচার প্রচারণায় যে উৎসব ছিল সেই অনুযায়ী ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি ছিল কম। ৫০ থেকে ৬০ ভাগ ভোট পোলের সম্ভাবনার কথা বলেছেন সংশ্লিষ্টরা।
সকালের দিকে বৃষ্টি হওয়ায় আবহাওয়া ভালো থাকায় ভোটকেন্দ্রগুলোর আশপাশে প্রচুর লোক সমাগম দেখা গেলেও ভোটকেন্দ্রে ছিল ভোটার উপস্থিতি কম। সারা দিন ঝির ঝির করে ভোটাররা আসেন কেন্দ্রে। এর মধ্যে মহিলাদের উপস্থিতি ছিল বেশি।
সকাল ৯টা পর্যন্ত কাউনিয়ার হারাগাছ সারাই পোদ্দার পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে সেখানে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আনোয়ারুল ইসলামের ছবি ও মোটরসাইকেল প্রতীক দিয়ে স্লিপ দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে সেখানকার প্রিজাইটিং অফিসার আব্দুর রকিব উদ্দিনকে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মাহফুজার রহমান মিঠুর বড় ভাই নির্বাচন মনিটরিং কমিটির সদস্য আশরাফুল ইসলাম অভিযোগ করলে প্রিজাইটিং অফিসার বুথে বুথে গিয়ে এ ধরনের স্লিপ এলে তার ভোট না নেয়ার নির্দেশ দেন। এর পরও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে তার ওপর ওই স্লিপে ভোট নেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়। এই ইস্যুতে হারাগাছ বকুলতলা পাটোয়ারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে পাঁচ জন আহত হয়।
এ বিষয়ে প্রিজাইটিং কর্মকর্তা আব্দুর রকিব জানান, বিষয়টি হাতেনাতে ধরার পর আমি নির্দেশ দিয়েছি এ ধরনের স্লিপে ভোট না নেয়ার জন্য।
এ ছাড়া কাউনিয়া আহম্মদ আলী সরকারি উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের পাশে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আনোয়ারুল ইসলাম মায়ার দুলাভাই সাখাওয়াত হোসেনের বাড়ি থেকে প্রত্যেক ভোটারকে ২০০ থেকে ৩০০ করে টাকা দেয়া হয়। বিষয়টি বিএনপি প্রার্থীর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হলে সেখানে অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হয়।
অন্য দিকে কোতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুল কাদের জিলানী নয়া দিগন্তকে জানান, আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে সদর উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী মাসুদ রানাকে পাগলাপীর থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এ দিকে পীরাগাছার জবানোবিশ বালিকা দাখিল মাদরারাসা ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ মিলন কেন্দ্রে ঢুকতে চাইলে পুলিশ তাকে বাধা দেয়। এ সময় সেখানে পুলিশের সাথে তার সমর্থকদের কথা কাটাকাটি হয়। পরে অতিরিক্ত পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ সময় ছবি ধারণ করায় স্থানীয় সাংবাদিক তাজরুল ইসলামের ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে ছবি ডিলিট করে দেন বিজিবি কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর।
বেলা ২টার সময় পীরগাছা ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে প্রভাব বিস্তার করার অভিযোগে পুলিশ গ্রেফতার করে কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ওয়াহেজ্জামান সুমনকে। এ ছাড়া এই উপজেলার চৌধুরানী উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর সমর্থকদের সাথে জাতীয় পার্টি সমর্থিত প্রার্থীর সমর্থকদের ধাওয়া ও হাতাহাতি হয়। একই ঘটনা ঘটে গাবুড়ার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। এখানে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থকদের সাথে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর সমর্থকদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়।
বাসাইল (টাঙ্গাইল) : গতকাল টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলা পরিষদ নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সকাল ৮টা থেকে টানা বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলে ভোটগ্রহণ। ভোট চলাকালীন সময়ে কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। তবে কোনো কোনো কেন্দ্রে ভোটার তালিকার সাথে নামের মিল না থাকায় কিছু ভোটার ভোট না দিয়েই ফিরে যান। কেন্দ্রগুলোয় ভোটারের উপস্থিতি ছিল কম। সকালে ভোটারের উপস্থিতি কম থাকলেও বেলা বৃদ্ধির সাথে সাথে ভোটার উপস্থিতি বাড়তে থাকে। আবার দুপুরের পর কেন্দ্র প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়। এর পর থেকে দু-একজন করে এসে ভোট দেন। আর মহিলা ভোটারদের চেয়ে পুরুষ ভোটারদের উপস্থিতি ছিল বেশ কম। এই নির্বাচনটি হওয়ার কথা ছিল গত ৩১ মার্চ। কিন্তু গত ২৯ মার্চ টাঙ্গাইল-৮ (বাসাইল-সখীপুর) আসনে সংসদ উপনির্বাচন থাকায় বাসাইল উপজেলা পরিষদ নির্বাচন স্থগিত রাখা হয়।
সকাল সাড়ে ৯টায় নথখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, মহিলা ভোটারদের ছোট্ট একটি লাইন। পুরুষ ভোটার আছেন হাতেগোনা কয়েকজন। এই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, দেড় ঘণ্টায় তিন হাজার ৪২০ জন ভোটারের ভোট দিয়েছেন আনুমানিক ৬০০ জন। বেলা সোয় ১১টায় কেবিএন উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় ভোটারদের ছোট ছোট কয়েকটি লাইন। ভোটার তালিকায় নামের সাথে মিল না থাকায় এই কেন্দ্রের বেশ কয়েকজন ভোটার ভোট দিতে পারেননি।

শেয়ার করুন