ভারতে নরেন্দ্র মোিদর নেতৃত্বে বিজেপির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠনের প্রাক্কালে এ বিষয়ে বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ৷
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ
ইমতিয়াজ আহমেদপ্রথম আলো : ভারতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপির বিপুল বিজয়ে বাংলাদেশি হিসেবে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে কি? বিশেষত, তিনি যেখানে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশি নিয়ে বৈরী কথাবার্তা বলেছিলেন।
ইমতিয়াজ আহমেদ : নির্বাচনী প্রচারণায় নরেন্দ্র মোদি দুটি ধারায় চলেছেন বা বলা যায়, দুটি বক্তব্য সামনে নিয়ে এসেছিলেন। একটি হলো উন্নয়নের ধারা, যাকে তিনি বলছেন গুজরাট মডেল। এই মডেল তৈরি করে সেটাকে বড় আকারে ভারতব্যাপী জনপ্রিয় করার কাজ করেছেন এবং ফলও পেয়েছেন। অন্যিট হলো সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বা বিভেদের ধারা। নির্বাচনের সময়ে বাংলাদেশ বিষয়ে সাম্প্রদায়িক কথাবার্তাও তিনি উত্থাপন করেছিলেন, এটাও কম সত্য নয়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। নির্বাচনের আগে আমরাও আমাদের দেশে দেখি যে ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতার ব্যবহার হচ্ছে। ভারতেও সেটা যে হয়, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু এখন তো বিজেপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গেছে।
বিজেপি যে এত বেশি আসন পাবে, তা মনে হয় স্বয়ং নরেন্দ্র মোদিও চিন্তা করেননি। তারা এমন আশাতীত সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে যে গত ৩০ বছরের রেকর্ড ভেঙে গেছে। গত ৩০ বছরের মধ্যে এই প্রথম ভারতের কেন্দ্রে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কোনো দল সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। মোদির নামেই যেহেতু বিজেপি নির্বাচন করেছে, সেহেতু এখন মোদির হাতে জমা হয়েছে একক ক্ষমতা। এ অবস্থায় অন্য কোনো দল বা গোষ্ঠীকে তাদের আর ধর্তব্যে না রাখলেও চলবে। ভোটাররাও এককভাবে তাঁকে শক্তিশালী করার মধ্য দিয়ে স্থিতিশীলতার প্রতি এবং কেন্দ্রে একটি স্থিতিশীল সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।
এ অবস্থায় নরেন্দ্র মোদির কাছে বিভেদের রাজনীতি প্রত্যাশিত নয়। আশা করি, বিভেদের রাজনীতিকে তিনি সামনে আনবেন না, সামনে আনবেন উন্নয়নের বিষয়িটই। বিভেদ ও তার থেকে জন্ম নেওয়া অস্থিতিশীলতার মধ্যে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। এত বড় সমর্থন নিয়ে বিভেদের রাজনীতি করা তাঁর জন্যও অনুচিত হবে। এ কারণে আমি মনে করি, নবনির্বাচিত ভারতীয় সরকারের প্রধান কাজ হবে উন্নয়নের ধারা সামনে রাখা। সেটা যদি হয়, তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বড় আকারে ভালো হবে এবং বাংলাদেশ এ সম্পর্ক থেকে লাভবান হবে।
প্রথম আলো : ভারতের জাতীয় কংগ্রেস দলের সঙ্গে বর্তমান সরকারের নিবিড় ঘনিষ্ঠতা কি বিজেপির সঙ্গে সরকারের যোগাযোগে বাধা তৈরি করে রাখবে?
ইমতিয়াজ : একটি জিনিস মনে রাখতে হবে। বর্তমান সরকারের সঙ্গে যেহেতু কংগ্রেসের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক হয়েগিয়েছিল, সেটার কারণে বিজেপির সঙ্গে একধরনের মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব কাজ করতে পারে। বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বিষয়ে কংগ্রেস সরকার নিষ্ক্রিয় হয়ে ছিল। অথবা বলা চলে, নির্বাচনের বিষয়ে আওয়ামী লীগ যা চেয়েছে, তা-ই পেয়েছে কংগ্রেসের কাছ থেকে। কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের প্রতি এ রকম বাধ্যবাধকতা নরেন্দ্র মোদির নেই। বাংলাদেশে যাতে তাড়াতাড়ি স্থিতিশীলতা আসে, উন্নয়নের স্বার্থেই নরেন্দ্র মোদির সে ব্যাপারে অগ্রাধিকার থাকবে। কারণ, তা ভারতের উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত। উত্তর-পূর্ব ভারতকে উন্নয়নের ধারায় আনতে হলে বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুসুলভ সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে ভারতকে। এবং এই পথেই দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান সমস্যার সমাধান হতে পারে।
বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারির ব্যাপারে একধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে, সেটা সমাধানের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এ ব্যাপারে ভারতেরও আগ্রহ থাকতে হবে। প্রথম পর্যায়ে হয়তো দুই দলের মধ্যে একধরনের সংলাপ দেখতে পাব। প্রথমত, আমাদের সমস্যা আমাদেরই মেটাতে হবে।
প্রথম আলো : বাংলাদেশ বিষয়ে বিজেপির কূটনৈতিক সাফল্যেরও তো প্রয়োজন রয়েছে। এ অবস্থায় সাম্প্রদায়িক নীতি প্রতিবন্ধক হবে কি না?
ইমতিয়াজ : নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বা বিজেপির সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব থাকলে সেটা কাজেই দেবে। ভারতেরও বাংলাদেশের বিষয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলে কাজ হবে না, উন্নয়নের স্বার্থে তো সহযোগিতার দরকার হবে। নরেন্দ্র মোদির মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। বিভেদের রাজনীতির তো তঁার আর দরকার হচ্ছে না। ভারতে তো বড় ধরনের সংখ্যালঘু রয়ে গেছে। সে কারণে জেনেশুনে সাম্প্রদায়িকতার বিষ পান করার তো কারণ নেই বিজেপির। তারা একাই যেহেতু সরকার গঠন করতে সক্ষম, সেহেতু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে তুষ্ট রাখা বা সেই ধারাকে সামনে নিয়ে আসারও কোনো কারণ নেই। আর জনগণও চাইবে উন্নয়নের ধারা। উন্নয়নের কাজে ব্যর্থ হলেই তবে দেখতে পাব, সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বাড়বে।
প্রথম আলো : মোদি তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ফেরত পাঠানোর কথা বলেছিলেন। এটি কি নিছকই নির্বাচনী প্রচারণা, না তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন?
ইমতিয়াজ : আমি আপাতত এটিকে তাঁর নির্বাচনী প্রচারণা হিসেবেই দেখছি। নির্বাচনের সময় তিনি বাংলাদেশবিরোধী কথা বললেও এত পরিমাণ ভোট পেয়ে তাঁর আর সেটা বলার প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া, বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণায় পশ্চিমবঙ্গে তিনি লাভবান হননি। লাভ হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তবে এ কথা ঠিক যে বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদি তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় বাংলাদেশকে সফট টার্গেট হিসেবে নিয়েছিলেন। একটি শঙ্কা থাকে যে, তাঁর সমর্থক গোষ্ঠীর মধ্যে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীও রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, তারা কী করবে? মোদি নির্বাচনে যে উন্নয়ন ও অগ্রগতির কথা বলেছেন, সে ক্ষেত্রে যদি তিনি কামিয়াব হতে পারেন তাহলে সাম্প্রদায়িক উপাদানগুলো ব্যবহারের প্রয়োজন পড়বে না। আমাদের প্রত্যাশা, মোদির শাসনামলে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকবে। কেননা, ভারতের করপোরেট জগৎ তাঁর প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছে। তারা কখনো চাইবে না সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হোক।
প্রথম আলো : মনমোহন সিং বাংলাদেশ বিষয়ে নরেন্দ্র মোদির জন্য পরামর্শ রেখে যাচ্ছেন বলে বলা হচ্ছে। এ ধরনের পরামর্শ কি বিজেপি আমলে নিতে পারে?
ইমতিয়াজ : ভারতের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বিষয়ে যে পরামর্শ রেখে গেছেন বলে বলা হচ্ছে, তা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে সেটা হবে কংগ্রেসের আরেকিট ভুল। মনমোহনের ব্যাপারে মোদির উচ্চ ধারণা নেই। তাই সে রকম কিছু রেখে গেলে নরেন্দ্র মোদি সেই কথা শুনবেন বলে যঁারা বিশ্বাস করছেন, তাঁরা নরেন্দ্র মোদিকে চিনলেন না, বিজেপিকে চিনলেন না। গুজরাটে তিনি যে এত দিন শাসন করেছেন, কীভাবে তিনি কাজ করেন, সে ব্যাপারেও তাঁদের ধারণা নেই। নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বিষয়ে কংগ্রেসের পথে চলবেন, তাই এমনটা মনে করার কারণ দেখা যাচ্ছে না।
প্রথম আলো : মোদির বিজয়ে বাংলাদেশের সব দলই অভিনন্দন জানিয়েছে, বিশেষ করে বিরোধী দল বিএনপি সবার আগে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছে। এটিকে কি ইতিবাচক বলে মনে করেন?
ইমতিয়াজ : ইতিবাচক তো বটেই। বাংলাদেশের সব দলই চায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটুক। বিশেষ করে, দ্বিপক্ষীয় যেসব সমস্যা আছে সেগুলোর সমাধান হোক।
প্রথম আলো : মোদির বিজয়ে উপমহাদেশে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে?
ইমতিয়াজ : পশ্চিমা বিশ্বে নরেন্দ্র মোদির একটি দুর্বল ইমেজ আছে। বিশেষ করে, গুজরাটের দাঙ্গার ঘটনায় তাঁর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। নাৎসি নেতা হিটলারের প্রশংসা করেও তিনি পশ্চিমা বিশ্বের বিরাগভাজন হয়েছেন। এখন তাঁর সামনে সুযোগ এসেছে উপমহাদেশ তথা পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে তাঁর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার। যেমনটি করেছিলেন অটল বিহারি বাজপেয়ি বিজেপির গত শাসনামলে। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যদি এখন চারটি বাস চলাচল করে থাকে, মোদির আমলে সেই সংখ্যা ১০টি হলেও অবাক হব না। অবাক হব না তাঁর বিদেশ সফর চীন দিয়ে শুরু হলে। তখন মোদি পশ্চিমা বিশ্বকে দেখাতে পারবেন, চীনের মতো বৃহৎ অর্থনীতির দেশের সঙ্গে তিনি সুসম্পর্ক চান।
প্রথম আলো : বিজেপির বিজয়ে ভারতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়ার আশঙ্কা আছে কি না?
ইমতিয়াজ : উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকলে সাম্প্রদায়িকতা খুব বেশি আঁচড় ফেলতে পারে না। কিন্তু মোদির প্রতিশ্রুত উন্নয়ন যদি না আসে, যদি মানুষ দারিদ্রে্যর বেড়াজালে বন্দী থাকে, তাহলে সাম্প্রদায়িক উসকানি বা উত্তেজনার আশঙ্কা থেকেই যায়।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ৷
ইমতিয়াজ : ধন্যবাদ৷