বৃহৎ প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের যেমন ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন, তেমনি ভারতের উন্নয়নে নরেন্দ্র মোদির সরকারেরও বাংলাদেশের বন্ধুত্ব প্রয়োজন হবে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র সচিব সি এম শফি সামি। তিনি গতকাল ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এ কথা বলেন।
শফি সামি বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ধারাবাহিকতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মোদি সরকার সজাগ থাকবে বলে মনে করি। তার সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্যে বাংলাদেশে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। তার এ বক্তব্যগুলো অনভিপ্রেত ছিল। বক্তব্যগুলো বাংলাদেশিদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। মোদি যে ধর্মীয় বিভাজনের ব্যাপারটিকে সামনে এনেছেন, তা পুরোপুরি অযৌক্তিক। তবে মোদির এ বক্তব্যগুলোকে বিভিন্ন কারণে গুরুত্ব দিতে চাই না। কারণ এগুলো ভোটের রাজনীতির জন্য দেওয়া বক্তব্য বলে আমি মনে করি। শফি সামি বলেন, একটু গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, মোদি তার ধর্মীয় বিভাজনমূলক বক্তব্য আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে জনসভায় দিয়েছেন। বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া এই দুই রাজ্যের জনগণ বিজেপিকে জানিয়ে দিয়েছে। পুরো ভারতে বিজেপির জয়জয়কার হলেও এই দুই রাজ্যে তেমন কোনো অবস্থান গড়তে পারেননি মোদি বা তার দল। সে হিসেবে এ বক্তব্য ভারতের জনগণই প্রত্যাখ্যান করেছে। তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি অবৈধ বাংলাদেশিদের নিয়ে মোদির বক্তব্যে অতি শঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। এ বক্তব্য তিনি শুধুই রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দিয়েছেন।
বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে আশাবাদী সি এম শফি সামি বলেন, প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্ক এখন যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে সেখান থেকে কোনো বিবেকবান সরকারের পিছিয়ে আসার সুযোগ আছে বলে মনে করি না। তবে এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক যতটা কাম্য ঠিক একইভাবে ভারতের জন্যও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের যেমন ভারতের বন্ধুত্ব প্রয়োজন, একইভাবে বৃহৎ রাষ্ট্র হলেও ভারতেরও বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রয়োজন। মোদি সরকার যদি ভারতকে শান্তি ও স্থিতিশীলতার সঙ্গে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে চায় তাহলে তাদেরও বাংলাদেশের বন্ধুত্ব দরকার হবে। তিনি বলেন, আজকের বিশ্ব পারস্পরিক নির্ভরশীল হয়ে গেছে। এখানে প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক শুধু প্রতিবেশীর স্বার্থে নয়, নিজের স্বার্থেও গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশের জনগণের মঙ্গলের জন্য এই বন্ধুত্বের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। এই দুই দেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেটা মোদির সরকার নিশ্চয়ই উপলব্ধিতে রাখবেন বা রেখেছেন।
সাবেক এই সফল কূটনীতিক বলেন, প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে নয়াদিলি্লর নতুন সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সরকারের নতুন করে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এখানে কোনো দলের বা ব্যক্তির সম্পর্কের কোনো বিষয় নয়। উভয় দেশের সরকারকে উভয়ের জনগণের স্বার্থ বজায় রেখে আলোচনার মাধ্যমে সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে হবে। আগের যে ব্যর্থতাগুলো বাংলাদেশের কূটনীতিতে ছিল তা কাটিয়ে উঠে নতুনভাবে আলোচনা শুরুর কোনো বিকল্প আছে বলে মনে করেন না সি এম শফি সামি।
ভারতে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে চলে আসা কংগ্রেস জোট সরকারের পরিবর্তনে ঢাকা-দিলি্ল সম্পর্কে কি কোনো চাপ আসবে? এমন প্রশ্নে কিছুটা সময় নিয়ে শফি সামি বলেন, বিষয়টি এক কথাতেই এখন বলা যাবে না। গভীর পর্যবেক্ষণ করতে হবে। দুই দেশেরই সরকারের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ককে কোনো দল বা জোটের সঙ্গে সম্পর্ক হিসেবে দেখলে চলবে না। দুটি দেশের মধ্যে আসলে সম্পর্ক হয় মানুষের সঙ্গে মানুষের। সরকারগুলোকে বলা হয় ‘গেটওয়ে’ (সংযোগস্থল)। এই গেটওয়ের মাধ্যমেই ওই দেশের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে হয়। এখন কংগ্রেস নেতৃত্বের জোটের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের জোটের সম্পর্ককে দৃষ্টিগোচর করা হলেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিজেপির শত্রুতা হবে- এমন তো কোনো কথা নেই। দলমতের ঊধের্্ব উঠে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে গুরুত্ব দিলে চলমান কূটনৈতিক সম্পর্ক নিশ্চয়ই গতিশীল থাকবে বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।
দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নত করতে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণের পাশাপাশি ‘প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা’র প্রয়োজন রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন শফি সামি। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো হয়তো কোনো সিদ্ধান্ত নেবে, কিন্তু প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও কিছু ভূমিকা রাখতে হয়। এখন দুটি দেশের মধ্যে কী ধরনের বা কী বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলে কী হবে তা শীর্ষ নেতৃত্বকে জানাতে হবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেই। কারণ একটি বিষয়ের অনেক প্রেক্ষাপট থাকে, কোন সিদ্ধান্ত নিলে কী হবে_ এ ধরনের বেশ কিছু বিষয় সরকারপ্রধান বা সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীকে জানাতে হবে। সততা, বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টির সঙ্গে অনেক বিষয় দেখারও প্রয়োজন রয়েছে বলে মন্তব্য করেন সি এম শফি সামি।