রমজান সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা তৎপর

0
126
Print Friendly, PDF & Email

নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে বাজার ব্যবস্থাপনা। বাজারে মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের নানা ধরনের হুমকি-ধমকির মধ্যেই এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে চলেছে। পণ্য মজুত করছে। সরকারের হুমকি-ধমকি কোনো কাজেই আসছে না। ক্রেতাদের অভিযোগ, সরকারের হাতে নয়, মূলত বাজারের নিয়ন্ত্রণ ব্যবসায়ীদেরই হাতে। তারা পণ্যের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে আগেভাগেই দাম বাড়িয়ে দেয়, তারপর রমজান মাসের শুরুতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে লোক দেখানো একাধিক বৈঠক করা হয়। বৈঠকে ‘আর দাম বাড়ানো হবে না’ বলে ব্যবসায়ীদের তরফ থেকে অঙ্গীকার করা হয়। অথচ দাম যা বাড়ানোর, তা আগেই বাড়িয়ে নেয়া হয়। প্রতি বছর সেই একই নাটক জানালেন ক্রেতারা। তারা জানান, প্রতি বছর রমজানের আগে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য সংস্থা টিসিবিকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়া হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে টিসিবির মাধ্যমে পণ্য আমদানি করে ন্যায্যমূল্যে ক্রেতাদের হাতে পৌঁছে দেয়ার ঘোষণা দেয়া হলেও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেই ক্রেতাদের উচ্চমূল্যে পণ্য কিনতে হয়। গতকাল রাজধানীর একাধিক বাজার ঘুরে দেখা গেছে, রমজান মাসের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাজারে। সাধারণ ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন অন্যান্য বছরের মতো এবারো আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা রমজান মাসে অতিরিক্ত মুনাফা তুলে নেয়ার টার্গেট করে ফেলেছে। রমজান শুরুর প্রায় দেড় মাস বাকি থাকতেই কিছু পণ্য এখনই মজুদ শুরু করে দিয়েছে একটি সিন্ডিকেট। একটি বহুল প্রচলিত ভোজ্যতেল কোম্পানি তাদের স্বাভাবিক সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। আদার দাম ইতোমধ্যে সাধারণের সাধ্যের বাইরে চলে গেছে। ডালের বাজারও গরম। মশলার দাম তেতে উঠছে।
ক্রেতাদের অভিযোগ, সরকার কোনোভাবেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। প্রতি বছর রমজান মাস এলেই কিছু উদ্যোগ নেয়া হয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে। এরপর বছরের ১১ মাস আর কোনো উদ্যোগ থাকে না। বাজারে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে। অভিভাবকহীন এ বাজার ব্যবস্থায় সরকারের কোনো ভূমিকাই থাকছে না। সরকারের বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন ক্রেতারা। তারা জানিয়েছেন একমাত্র খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খোলা বাজারে চাল বিক্রি ছাড়া আর কোনো উদ্যোগ নেই। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা এসব সিন্ডিকেটের তালিকা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন নেয়া হচ্ছে না। আগে শুধুু আমদানির মাধ্যমে আসা পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেছে এসব সিন্ডিকেট। এখন দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্যও চলে গেছে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। এর ফলে মাঠপর্যায় থেকে বিভিন্ন ধরনের সবজি রাজধানীতে এসে বিক্রি হচ্ছে তিন থেকে চার গুণ মূল্যে। এ সিন্ডিকেটের তৎপরতায় ভোক্তা সংরক্ষণ আইনের খসড়াটি ফাইলবন্দী ছিল ১৬ বছর। তার পর ২০০৮ সালের ৬ অক্টোবর অধ্যাদেশটি রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করেন। পরে জাতীয় সংসদে ‘ভোক্তা সংরক্ষণ আইন পাস হয়। এ ছাড়া সম্প্রতি সংশোধিত আকারে ‘প্রতিযোগিতা আইন, ২০১১’ অনুমোদিত হয়েছে। অসৎ ব্যবসায়িক উদ্দেশে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা রোধ এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টি করে ভোক্তাদের স্বার্থরক্ষায় ভোক্তা সংরক্ষণ আইনের মতোই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়।
ক্রেতাদের অনেকেই জানালেন, তারা দীর্ঘ দিন ধরে শুধু শুনেই আসছেন রাজধানীতে চারটি পাইকারি কাঁচা বাজার স্থাপনে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। অথচ এখন পর্যন্ত তা বাস্তাবায়ন করতে পারেনি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রস্তাবিত পাইকারি বাজার স্থাপনের ফাইলটি এখন চাপা পড়ে আছে। বিভিন্ন সময় মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে আলোচনা করা হলেও বিষয়টি আর এগোয়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যশোর, নরসিংদী, সাভার, কুমিল্লার চান্দিনার মতো যেসব স্থানে অধিক পরিমাণে শাকসবজি উৎপন্ন হয় সেসব স্থান থেকে পণ্য কাওরানবাজারে বাজারজাতকরণের অসুবিধার কারণেই মধ্যস্বত্বভোগীরা এর সুবিধা নিয়ে থাকে। এর স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবেই এসব পণ্যের দাম বেড়ে থাকে। এ পরিস্থিতি বিবেচনা করেই সরকার রাজধানীতে প্রথমে ছয়টি এবং পরে চারটি পাইকারি বাজার স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিল। রাজধানী ঢাকায় প্রায় দেড় কোটি লোকের বাস। অত্যাধিক জনসংখ্যার এ শহরে পাইকারি শাকসবজির বাজার মাত্র দু’টি। একটি রাজধানীর কাওরান বাজারে, আরেকটি শ্যামবাজারে। চাহিদা অনুযায়ী এসব বাজার থেকে সঠিকভাবে পণ্য সরবরাহ হচ্ছে না। এর ফলে যৌক্তিক মূল্যে শাকসবজি কিনতে পারছেন না ক্রেতা সাধারণ।
অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার প্রায় তিন বছরেও ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) কার্যপরিধি বাড়েনি। মহাজোট সরকার প্রথম ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ২০ জানুয়ারি তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী ড. মো: আবদুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, টিসিবির কার্যপরিধি বাড়িয়ে এর মাধ্যমে চাল, ডাল, আটা ও তেল আমদানি করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ নির্দেশ দিয়েছেন বলে তিনি জানিয়েছিলেন। এ নির্দেশনার পর টিসিবিকে কার্যকর করতে এবং এর কার্যপরিধি বাড়াতে কয়েকবার সরকারের তরফ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়। কর্মকর্তারা জানান, পাঁচ বছর পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়নি। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সর্বশেষ টিসিবিকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এ ব্যাপারে কমিটি ৯ দফা সুপারিশ করে। এর মধ্যে ২৫০ কোটি টাকার স্থায়ী তহবিল, বার্ষিক সরকারি কাউন্টার গ্যারান্টি সুবিধার আওতায় ৫০০ কোটি টাকার ঋণ এবং ৫৬ কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে। টিসিবিকে প্রয়োজনীয় তহবিল সরবরাহের পাশাপাশি টিসিবির স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি ও জনবলের যথাযথ ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়েছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কবল থেকে এখনো মুক্ত হতে পারেনি ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। টিসিবির মাধ্যমে কিছু পণ্য আমদানির ঘোষণা এলেও এখন পর্যন্ত অনেকটাই নিষ্ক্রিয় সংস্থাটি। সরকারের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, টিসিবি অনেকটাই রাজনৈতিকরণের শিকার। সরকারের ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যবসায়ীর প্রভাবে সংস্থাটি স্বাভাবিক কাজ করতে পারছে না। এক সময় টিসিবিতে ১৪ শ’ লোকবল ছিল। বর্তমানে মাত্র ১২৫ জনের মতো লোকবল রয়েছে।

শেয়ার করুন