নারায়ণগঞ্জে অপহরণ ও ৭ খুন : ১৭ দিনেও গ্রেফতার হয়নি আসামিরা; ৩ দিনেও কার্যকর হয়নি হাইকোর্টের আদেশ অপহরণে অংশ নিয়েছিল ২৫ জন। এরমধ্যে চারজনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মামলা হয়েছে। র্যাবের তিন কর্মকর্তা অন্তরীণ রয়েছেন। যদিও গতকাল পর্যন্ত বলা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায়নি। অন্যদের ব্যাপারে এখনো কোনো তথ্য মেলাতে পারেনি তদন্তকারীরা। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাকিরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বলেই তাদের ধারণা। যে বক্তব্য এক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনাতেও উঠে এসেছে। এ দিকে ঘটনার ১৭ দিন পরেও একজনকেও গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। নারায়ণগঞ্জের এসপি ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেছেন, ‘মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশে কাজ করছি, শিগগিরই ফল পাবেন বলে আশা করছি।’
অপহরণের চার দিন পর গত ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদী থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং নাসিকের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও নারায়ণগঞ্জ আদালতের সিনিয়র আইনজীবী চন্দন সরকারসহ ছয়টি লাশ উদ্ধার হয়। পরদিন সকালে উদ্ধার করা হয় আরো একটি লাশ। গত ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ থেকে অপহৃত হন নজরুল, তার তিন বন্ধু তাজুল, স্বপন, লিটন ও নজরুলের ড্রাইভার জাহাঙ্গীর, এ্যাডভোকেট চন্দন সরকার ও তার গাড়ির ড্রাইভার ইব্রাহিম। অপহরণ ঘটনার পরই নাসিকের ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সিদ্ধিরগঞ্জ আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি নূর হোসেন, থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াসিন, নজরুলের চাচাশ্বশুর হাসমত আলী হাসু, ইকবাল হোসেন ও আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে ফতুল্লা থানায় মামলা করা হয়। এই ঘটনায় গত ৬ মে থেকে র্যাব-১১ এর সাবেক সিও লে. কর্নেল তারেক মোহাম্মদ সাঈদ, মেজর আরিফ এবং লে. কমান্ডার রানাকে অন্তরীণ করা হয়। সে থেকেই তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মামলার সুনির্দিষ্ট চার আসামি এবং র্যাবের তিন কর্মকর্তা ছাড়া এখনো কাউকে এই ঘটনায় শনাক্ত করা যায়নি। যদিও র্যাবের তিন কর্মকর্তার ব্যাপারে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায়নি বলে দাবি করেছেন একজন কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, তিন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। জিজ্ঞাসাবাদে কোনো তথ্য পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সূত্র জানায়, অপহরণের সাথে জড়িত ছিল প্রায় ২৫ জন। এর মধ্যে প্রায় সবাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ছিল বলে ওই সূত্রটি উল্লেখ করে। প্রশ্ন জেগেছে বাকিরা কোথায়? নিহতদের পরিবারের সদস্যরা সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন, সাতজন মানুষকে অপহরণে কমপক্ষে ২১ জন লোক লেগেছে। তাহলে প্রশ্ন জেগেছে বাকিরা কারা? সে ব্যাপারে এখনো সুনির্দিষ্ট তথ্য উদঘাটন করতে পারেননি মামলার তদন্তকারীরা। তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, বাকিদেরকে নিয়ে কোনোই মাথাব্যথা নেই তদন্তকারীদের। যাদের এই ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে তাদের অনেকেই এখনো নারায়ণগঞ্জে দায়িত্বরত আছেন। যদিও তাদেরকে এখন মাঠে-ঘাটে বেশি দেখা যায় না বলে একাধিক সূত্র জানায়। এ দিকে ১৭ দিনেও দুর্বৃত্তদের শনাক্ত করতে না পারার বিষয়ে জানার জন্য ফোন করা হয়েছিল নারায়ণগঞ্জের ওসি ডিবির সাথে।
এ দিকে হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে গণশুনানিতে জালালউদ্দিন নামে এক ব্যক্তি ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন। সাক্ষ্যপ্রদান শেষে সাংবাদিকদের তিনি জানিয়েছেন, ঘটনার সময় তিনি ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের লামাপাড়া এলাকায় ময়লার স্তূপের পাশে বসে প্রস্রাব করছিলেন। সেখানে র্যাবের একটি গাড়ি ও একটি কালো রঙের ১২ থেকে ১৩ সিটের মাইক্রোবাস আগে থেকেই অবস্থান করছিল। ওই সময় তারা দু’টি প্রাইভেটকার আটক করে। সাদা রঙের একটি প্রাইভেটকারে ছিলেন প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ পাঁচজন এবং নীল রঙের প্রাইভেটকারে ছিলেন আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক। র্যাবের কর্মকর্তারা ওই প্রাইভেটকার দু’টি থেকে তাদের নামিয়ে কালো রঙের ওই মাইক্রোবাসে উঠিয়ে ¯েপ্র ছিটিয়ে দিলে এক মিনিটের মধ্যেই তারা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পরে কালো রঙের মাইক্রোবাসটি ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলী জাতীয় স্টেডিয়ামসংলগ্ন তক্কার মাঠের বিপরীতে লামাপাড়া মার্কাজ মসজিদের সামনের সড়ক দিয়ে চলে যায়। ঘটনার সময় লিংক রোডের অপরপ্রান্তে একটি প্রাইভেটকারে ছিলেন নূর হোসেন ওরফে হোসেন চেয়ারম্যান।
এ দিকে তিন র্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের ব্যাপারে হাইকোর্টের নির্দেশনার পরেও তাদেরকে গতকাল পর্যন্ত গ্রেফতার দেখানো হয়নি। মামলায় যাদেরকে সুনির্দিষ্ট আসামি করা হয়েছে তাদের কাউকেও গ্রেফতার করা হয়নি। তবে পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন তার নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের জানান, তিনজনকে গ্রেফতারের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানোসহ আইনগত প্রক্রিয়া চলছে। আইনগত প্রক্রিয়া শেষ হলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, তিনজনকে গ্রেফতারের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের চাপ নেই। সাতজন হত্যার মতো একটি বড় ঘটনায় পুলিশ প্রশাসন পরিকল্পিতভাবে এগোচ্ছে। দৃশ্যমান না হলেও পুলিশ তদন্তের অনেক কাজ করছে। তদন্তের প্রক্রিয়াগুলো প্রকাশ হলে মামলা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।