ব্যবসায়-বাণিজ্য মন্দা ভাব যেন কাটছে না। বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ অবকাঠামো সুবিধার অভাব, চলমান পরিস্থিতিতে আস্থার সঙ্কটে বিনিয়োগ স্থবিরতা যেন দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। ব্যবসায়-বাণিজ্যের এ অচলাবস্থায় বেকায়দায় পড়েছেন ব্যবসায়ী, বিশেষ করে মধ্যবর্তী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। লোকসানের ঘানি টানতে টানতে একসময়ে হাঁপিয়ে উঠছেন। সবচেয়ে বেকায়দায় আছেন ঋণনির্ভর ব্যবসায়ীরা। তারা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। ফলে বেড়ে যাচ্ছে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ। অন্তত বাংলাদেশ ব্যাংকের শিল্পের মেয়াদি ঋণের কিছু পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে এ চিত্র আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বড়, মাঝারি ও ছোট মাপের শিল্পকারখানায় বিভিন্ন অঙ্কের মেয়াদি ঋণ বিতরণ করে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এসব ঋণ বিতরণ ও আদায়ের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সবচেয়ে বেকায়দায় রয়েছেন মাঝারি আকারের ব্যবসায়ীরা। গত ২০১১-১২ অর্থবছরে মাঝারি মানের ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়ের জন্য যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল তা থেকে আদায় হয়েছিল ৯ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা। পরের অর্থবছরে অর্থাৎ ২০১২-১৩ অর্থবছরে মাঝারি মানের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ আদায় কমে হয় ৯ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা। একইভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে তা আরো কমে যায়।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মাঝারি মানের ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছেন। তবে সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণ করলে সব ধরনের ব্যবসায়ীদের একই অবস্থা।
একজন শিল্পোদ্যোক্তা জানান, আগে শিল্পকারখানায় গ্যাস বিদ্যুৎ সংযোগ সহসাই পাওয়া যেত। কিন্তু এখন গ্যাস, বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য মধ্যস্বত্ব¡ভোগীদের পেছনে ঘুরতে হয়। তাদের পেছনে ব্যয় করতে হয় বিপুল অর্থ। শিল্পের অন্যতম এ দু’টি উপাদানের সংযোগ পেতে এখন প্রতি পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের। এর বাইরে পারিপার্শি¦কতা তো রয়েছেই। সব মিলে উদ্যোক্তারা শিল্পমুখী হচ্ছেন না। এতে প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে সামজিক অস্থিরতা প্রকট আকার ধারণ করবে।
কথাগুলো বলেছিলেন দেশের প্রতিষ্ঠিত একজন শিল্পোদ্যোক্তা। এ উদ্যোক্তার মতো হাজারো উদ্যোক্তার একই সমস্যা। তারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিল্পকারখানায় গ্যাস, বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে চান। নতুন নতুন শিল্পকারখানার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে চান। কিন্তু তারা তা পারছেন না।
বিনিয়োগ বোর্ডের পরিসংখ্যাম মতে, মাত্র এক মাসের ব্যবধানে জানুয়ারির তুলনায় বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে প্রায় ৮২ শতাংশ, আর কর্মসংস্থান কমেছে ৮৭ শতাংশ। গত জানুয়ারিতে বিদেশী ও যৌথ বিনিয়োগ হয়েছিল ৮১৬ কোটি টাকার। ফেব্রুয়ারিতে এসে তা কমে নেমেছে দেড় শ’ কোটিতে। এ কারণে নতুন কর্মসংস্থানও কমে গেছে। জানুয়ারিতে বিদেশী ও যৌথ বিনিয়োগ থেকে কর্মসংস্থান হয়েছিল পাঁচ হাজার ৫৫৮ জনের। ফেব্রুয়ারিতে তা নেমেছে ৭৩২ জনে। শুধু বিদেশী ও যৌথ বিনিয়োগ নয়, স্থানীয় বিনিয়োগেও ভাটা পড়েছে। জানুয়ারিতে স্থানীয় বিনিয়োগ হয়েছিল চার হাজার ৩০৩ কোটি টাকার। ফেব্রুয়ারিতে তা নেমেছে দুই হাজার ৬০৩ কোটিতে।
বর্তমান সরকারের গত মেয়াদের বেশির ভাগ সময়েই গ্যাস সঙ্কটের কারণে শিল্পকারখানায় গ্যাস সংযোগ বন্ধ ছিল। আর তার সাথে ছিল বিদ্যুৎ সঙ্কট। এর ফলে বিনিয়োগে ভাটা ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, গার্মেন্টে আগুন, ভবন ধস সব মিলিয়ে বিনিয়োগের চাকা বর্তমানে একেবারেই স্থবির হয়ে পড়েছে। গত সাড়ে চার বছরের মধ্যে বিনিয়োগ সর্বনি¤œ পর্যায়ে নেমে এসেছে।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ অবকাঠামো সুবিধার অভাবের পাশাপাশি চলমান পরিস্থিতিতে আস্থার সঙ্কটে ভুগছেন ব্যবসায়ীরা। সব ধরনের বিনিয়োগ থেকে কার্যত তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। আর পুরনো শিল্পকারখানা টিকে রাখাই দায় হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতি নতুন বিনিয়োগের ব্যাপারে তারা ভাবতেও পারছেন না।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, দীর্ঘ দিন যাবৎই ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগ শূন্যতা রয়েছে। চলমান পরিস্থিতির কারণে বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকের দিকে আসছেন না। নতুন কোনো শিল্পকারখানায় বিনিয়োগ নেই। বিনিয়োগ মন্দার প্রভাবে আমানতের সুদের হার কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু পরিচালন ব্যয় না কমায় সুদের হারে তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারছেন না। আবার বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে চলছে। এ দিকে ব্যবসায়-বাণিজ্যের মন্দার কারণে ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। এতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। আর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে। এতে ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা কমে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশির ভাগ ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা গত বছরের চেয়ে কমে গেছে। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে সামনে ব্যাংকিং খাতের জন্য অশনি সঙ্কেত অপেক্ষা করছে বলে তারা মনে করছেন।
ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাদের মতে, দেশের চলমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগমুখী করতে অবকাঠামো সুবিধা বাড়াতে হবে। বিদ্যুৎ, গ্যাস সংযোগের নীতিমালা সহজ করতে হবে। এতে দুর্ভোগ কমাতে হবে উদ্যোক্তাদের। একজন উদ্যোক্তা বলেন, শুধু শিল্প কারখানায় বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগের নীতিমালা সহজ করা হলে অনেকেই বিনিয়োগমুখী হবে। এতে বর্ধিত হারে বাড়বে কর্মসংস্থান, যা জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।