পাওনা টাকা আদায় বাংলাদেশে সত্যিই এক বড় সমস্যা। আমরা নানা কারণেই লোকজনকে টাকা দিয়ে থাকি। কখনো বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছায়, কখনো কারও ব্যবসায় কিছু বিনিয়োগ করে লাভের আশায় বা নিছক সুদের লোভে। কখনো বা কাউকে সাহায্য করার জন্য শুধুই ধার হিসেবে। এসব টাকা ভুল লোকের হাতে গিয়ে পড়তেই পারে। টাকা দিলেন, কিন্তু বিদেশ যাওয়া হলো না, বা আশা করেছিলেন কিছু লাভ মিলবে, তা হয়তো মিলল না; কিন্তু টাকা তো ফেরত পাওয়া চাই! কিন্তু কীভাবে? এসব লেনদেনের কাগজপত্র অনেক ক্ষেত্রেই থাকে না, ফলে আইনের এখানে খুব কিছু করার থাকে না। আর থাকলেও বা কী! থানা-পুলিশের অবস্থা তো আমাদের জানা। বাংলাদেশে আইন-আদালতের ঝক্কি-ঝামেলায় কে যেতে চায়!
এসব অসহায় ও বিপদাপন্নদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে ছাত্রলীগ। আপনি কারও কাছ থেকে টাকা পান তো ছাত্রলীগের নেতাদের জানান,তাঁরা টাকা উদ্ধারে আপনাকে সহায়তা করবেন। ছাত্রলীগ যে অসহায় পাওনাদারদের গোপনে এ ধরনের ‘সেবা’ দিয়ে আসছিল, তা আমাদের অনেকের কাছেই অজানা ছিল। সেবামূলক কাজ নাকি গোপনেই করতে হয়! গত মাস তিনেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গোটা পাঁচেক অপহরণের ঘটনার পর এই ‘গোপন সেবা’ দেওয়ার বিষয়টি আর গোপন থাকল না। নানা অনুসন্ধানে বের হয়ে গেল এসব অপহরণের সঙ্গে ‘পাওনা টাকা উদ্ধারের’ বিষয় জড়িত।
তবে ‘সেবামূলক কাজ’-এর ‘স্বীকৃতি’ সব সময় মেলে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফল হয় উল্টো। এবার বিপদে পড়ে গেছেন ছাত্রলীগের চার নেতা-কর্মী। সংগঠন ও বিশ্ববিদ্যালয়—দুই তরফ থেকেই বহিষ্কারের শিকার হয়েছেন ‘বেচারা’ চার ছাত্রলীগ কর্মী। গত শুক্রবার এ ধরনের টাকা উদ্ধারকাজে অপহরণের ঘটনায় আটক ছাত্রলীগের ছয়জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে পাঠানো হয়েছে আদালতে। একজন এখন আছেন তিন দিনের রিমান্ডে। এ ধরনের কাজকে তো তঁারা কখনো অপরাধ হিসেবে বিবেচনাই করেননি। পাওনা টাকা উদ্ধারে চুক্তিভিত্তিক ভাড়ায় কাজ করার ‘সেবা’ ছাত্রলীগের কেউ কেউ দিয়ে আসছেন বেশ কিছুদিন ধরেই। পাওনাদারকে টাকা উদ্ধার করে দিয়ে যদি তাঁরা কিছু পেয়ে থাকেন, সেটা তো নিতান্তই ‘সার্ভিস চার্জ’!
ছাত্রলীগ একটি বড় সংগঠন। এর সব নেতা-কর্মীর জন্য বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা, ঠিকাদারির কাজ ভাগাভাগি করে দেওয়া বা চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির সুযোগ করে দেওয়া খুবই কঠিন। ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের নিশ্চয়ই এসব সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। এসব কাজের চেয়ে অসহায় পাওনাদারদের সহায়তায় ছাত্রলীগকে কাজে লাগানোই তো ভালো! পাওনা টাকা আদায়ের জন্য অনেকেই মাথার চুল ছিঁড়ছেন, কিন্তু কোনো উপায় পাচ্ছেন না। এই হতভাগাদের বড় সহায় হতে পারে ছাত্রলীগ। টাকাও উদ্ধার হলো আর ছাত্রলীগের ছেলেপেলেরাও কিছু পেল। এভাবে বিষয়টি ভেবে দেখলে ক্ষতি কী!
অনেক পাওনাদারের কাছে নিশ্চয়ই এটা এত দিন জানা ছিল না যে টাকা উদ্ধারের জন্য ছাত্রলীগকে ভাড়া করার যায়, এখন অনেকে জেনেছেন। কিন্তু তাঁরা কোথায় খুঁজতে যাবেন ছাত্রলীগের কর্মীদের! ফলে একটি নিয়মের মধ্যে কাজটি করাই ভালো, একটি কাঠামো দাঁড় করিয়ে ফেললেই হয়! পাওনা টাকা আদায়ের জন্য ‘এখানে ছাত্রলীগ কর্মী ভাড়া পাওয়া যায়’ ফুটপাত বা সরকারি জায়গা দখল করে এ ধরনের একটি ছোট অফিস-ধরনের কিছুও করা যেতে পারে!
‘ছাত্রলীগ ভাড়া খাটছে’ প্রথম আলোতে এমন একটি তরতাজা শিরোনাম আর সরকারি দলের ছাত্রসংগঠন হওয়ার কারণে ছাত্রলীগের জন্য পরামর্শের ডোজটি হয়তো একটু বেশিই হয়ে গেল! কিন্তু এই পরামর্শ আসলে শুধু ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের জন্যই নয়, সবার জন্যই খাটে। সমাজের সবাই তো আমরা ভাড়াই খাটছি। অনেক রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারক ভাড়া খাটছেন ব্যবসায়ী বা ভূমি দখলদারদের হয়ে, অন্য কোনো দেশের স্বার্থে অথবা কোনো বিদেিশ কোম্পানির পক্ষে। একই কায়দায় ভাড়ায় খাটছেন অনেক আমলা, ভাড়া করা যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজনকেও। দল ও গোষ্ঠীর হয়ে ভাড়ায় খাটছেন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী৷ সাংবাদিকেরাই বা এ থেকে বাদ যাবেন কেন? আমরাও খুব পিছিয়ে নেই। এটা যে ভাড়া খাটারই যুগ! ভাড়া খাটার জয় হোক।