খালেদার হুমকিতে বিচলিত এরশাদ

0
132
Print Friendly, PDF & Email

এরশাদ জিয়াউর রহমান ও মঞ্জুরের খুনি। এই খুনির বিচার হবে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার এমন হুমকিতে বিচলিত হয়ে পড়েছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

এমনিতেই মঞ্জুর হত্যা মামলা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন, তার ওপর বেগম খালেদা জিয়া তাকে জিয়া ও মঞ্জুরের খুনি আখ্যায়িত করায় এ দুশ্চিন্তায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এ নিয়ে এরশাদের জাতীয় পার্টিতেও শুরু হয়েছে তোলপাড়। বেগম জিয়ার এ বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে প্রায় প্রতিদিনই চলছে দলের প থেকে নানা কর্মসূচি। বিভিন্ন রাজনৈতিক সহিংসতায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় খালেদা জিয়াকে দায়ী করে তার বিচারও দাবি করছে দলটি।

দীর্ঘ দিন পর বেগম জিয়ার মুখ থেকে এরশাদের বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় এমন অভিযোগ শুনে রাজনৈতিক মহলে নতুন করে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখছেন না। জিয়া ও মঞ্জুরের খুনি এরশাদ সরাসরি এমন অভিযোগ বেগম জিয়া গত ৩৪ বছরেও কখনো করেননি। তার এ বক্তব্যের পেছনে নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। এ দু’টি হত্যাকাণ্ডের সাথে এরশাদকে জড়িয়ে হঠাৎ করে তার এমন বক্তব্যে শুধু জাতীয় পার্টিতেই নয়, রাজনৈতিক অঙ্গনেও তোলপাড় চলছে। ফলে বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখার কোনো কারণ নেই বলে মনে করছেন রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা।

এ দিকে ভীতি কাটাতে খালেদা জিয়াকেও পাল্টা খুনি আখ্যায়িত করে তার বিচার দাবি করেছেন এরশাদ। মানুষ খুনের জন্য খালেদার বিচার হবে মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, গাইবান্ধা, কানসাট ও সাম্প্রতিক আন্দোলনে মানুষ খুনের জন্য আপনার (খালেদা) বিচার হবে। সামনে মামলা আছে, রায়ে তার জেলও হতে পারে। সাবেক এই রাষ্ট্রপতির প্রশ্ন যখন আমার সাথে হাত মেলাতে এসেছিলেন তখন তো আমি খুনি ছিলাম না, তাহলে হঠাৎ করে খুনি হলাম কেন?

খালেদা জিয়ার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় এরশাদ বলেন, তিনি (খালেদা জিয়া) ১০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তখন বিচার করলেন না কেন? যখন আমাদের সাথে জোট হওয়ার কথা ছিল, তখন তো আমাদের সাথে বৈঠক হয়েছে। তাহলে কি তিনি স্বামীর খুনির সাথে হাত মিলিয়েছিলেন? তিনি বলেন, জেনারেল জিয়া ও মঞ্জুর হত্যার ঘটনা ঘটেছে ৩৪ বছর আগে। মামলা হয়েছে ১৫ বছর পর। যারা তখন মতায় ছিলেন তারা বিচার করলেন না কেন?

উল্লেখ্য, নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনার পর গত রোববার জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিএনপির গণ-অনশন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগের উদ্দেশে বলেছেন, আপনারা খুনিদের সাথে বসবাস করছেন, খুনিকে উপদেষ্টা বানিয়েছেন। এরশাদ হলো খুনি। এরশাদ জিয়াউর রহমানের খুনি, মঞ্জুরের খুনি। খুনি এরশাদের বিচার হবেই।

জাপার একাধিক সূত্র জানায়, মঞ্জুর হত্যা মামলার আইনি জটিলতার কারণে এরশাদ প্রতিদিনই কাকরাইলে পার্টির নতুন কেন্দ্রীয় অফিসে আসতেন। মামলার খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে দলের আইনজীবী শেখ সিরাজুল ইসলামের সাথে কথা বলতেন। মামলাটি আরো জটিল আকার ধারণ করতে পারে, এ নিয়ে এরশাদ খুবই দুশ্চিন্তায় থাকেন। তাই বাধ্য হয়েই সরকারের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হচ্ছে। সরকারের বিরুদ্ধে বক্তৃতা-বিবৃতি দিলেও ভেতরে ভেতরে সরকারের ওপর মহলের সাথে যোগাযোগ রা করে চলছেন। আর এই যোগযোগ রায় সেতু হিসেবে কাজ করছেন দলের নয়া মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলু ও পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ।

তার ওপর সংসদের বিরোধী দলের নেতা পার্টির সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম রওশন এরশাদ তো আছেনই। ফলে আপাতত তেমন একটা সমস্যা হচ্ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করে বেগম জিয়ার এমন বক্তব্যে নতুন করে এরশাদকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে বলে তারা মনে করছেন।

তা ছাড়া এমনতিইে নানা ঘটনায় চতুর্মুখী চাপের মুখে আছেন এরশাদ। মঞ্জুর হত্যা মামলার অধিকতর তদন্ত শুরু, সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশ যাওয়ার চাপ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান পদ ছাড়ার ব্যাপারে দলের মধ্য থেকেই জোরালো দাবির পর সর্বশেষ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তাকে ‘জিয়ার খুনি’ মন্তব্য করায় এরশাদ আরো চাপে পড়েছেন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলাতেই শেষ পর্যন্ত ধরাশায়ী হতে পারেন তিনি। এর সাথে এখন আবার যুক্ত হতে যাচ্ছে জেনারেল জিয়া হত্যা মামলাটি। শুধু যে দলীয় ও বিএনপির চাপ এরশাদকে সহ্য করতে হচ্ছে তা নয়।

এরশাদকে প্রতিনিয়ত সরকারেরও নানা চাপ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সরকার চাচ্ছে এরশাদ বিদেশ চলে যাক। তিনি যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত, তাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকারের প্রতিনিধিত্ব করুক। আর এরশাদের অবর্তমানে রওশন বা ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ পার্টির হাল ধরুক। কিন্তু বিদেশে গেলে পার্টির নিয়ন্ত্রণ তার হাতে থাকবে না এটা বুঝতে পেরেই তিনি বিদেশে যাচ্ছেন না। অথচ সরকারকে তিনি বারবার আশ্বাস দিচ্ছেন যে, চিকিৎসার জন্য হলেও তিনি সিঙ্গাপুর যাবেন।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, রংপুরের নিজ বাসভবন পল্লী নিবাসে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে টেলিভিশনে খবর শুনছিলেন এরশাদ। হঠাৎ করেই খালেদা জিয়ার এমন মন্তব্যে অনেকটাই হতচকিত হয়ে পড়েন তিনি। এরপরই তিনি পাশের রুমে চলে যান। এ সময় তাকে বেশ বিচলিত দেখা গেছে বলে সূত্রের দাবি। কারণ মঞ্জুর হত্যা মামলার অধিকতর তদন্তের জন্য ইতোমধ্যে তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাহহার আকন্দ তিন মাস সময় চেয়েছেন। তিনি সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলৎজের কাছে মামলাসংক্রান্ত কাগজও চেয়েছেন বলে জানা গেছে।

এ দিকে গত ২৭ এপ্রিল জাপার প্রেসিডিয়াম ও সংসদ সদস্যদের যৌথ সভাতেও এরশাদকে তোপের মুখে ফেলেছিলেন তারই সহধর্মিণী ও বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদ। তিনি এরশাদকে উদ্দেশ করে বলেছেন, তুমি (এরশাদ) একরোখা, কর্মচারীদের গুরুত্ব দাও, তোমার স্টাফরা কেন পার্টি নিয়ন্ত্রণ করবে? সারাদিন তাদের কান কথা শোনো। নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পার না। তোমার কর্মচারীদের পরামর্শে তুমি দলীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকো।

রওশন বলেন, তোমার জন্য পার্টিতে বারবার ভাঙন হয়েছে। তুমি কোনো সিদ্ধান্তেই স্থির থাকতে পার না।

এ সময় একাধিক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও দলীয় সংসদ সদস্যরা পার্টিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পদ সৃষ্টিরও দাবি জানান।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী বলেন, এরশাদের নীতিহীন রাজনীতির কারণে এ দেশে নীতিভ্রষ্ট রাজনীতির সৃষ্টি হয়েছে। মঞ্জু ও জিয়া হত্যা মামলায় এরশাদ জড়িত এটা এ দেশের মানুষ বিশ্বাস করে। এ জন্যই এখন নিজের দলের নেতা ও এমপিরাই এরশাদকে পার্টি থেকে সরাতে চাচ্ছেন বলে শোনা যাচ্ছে। এরশাদের রাজনীতি করা আগামীতে খুব কঠিন হবে।

কারণ এখন কোনো দলেরই তার প্রতি কোনো আস্থা নেই। অনেকটা আস্থাহীনতা নিয়েই তাকে আগামী দিনে পথ চলতে হবে।

শেয়ার করুন