জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে ‘নীরব নারী নির্যাতনের’ অভিযোগ করেছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ চূড়ান্ত বর্ষের এক ছাত্রী। তাঁর অভিযোগ, ওই শিক্ষকের অসাধু আমন্ত্রণে সাড়া না দেওয়ায় তাঁকে পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগবঞ্চিত করছেন ওই শিক্ষক। জহীর উদ্দিন আরিফ নামের ওই সহযোগী অধ্যাপকের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে অভিযোগ করেছেন ওই ছাত্রী। অভিযোগের ব্যাপারে জহীর উদ্দিন আরিফের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কোনো শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় সুযোগ দেওয়া না-দেওয়ার বিষয়টি বিভাগের একাডেমিক কমিটির। নির্যাতনের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওই ছাত্রী হয়তো রাগ বা কষ্ট থেকেই এ অভিযোগ করেছেন।’ কী ধরনের রাগ বা অভিযোগ, সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে তিনি অস্বীকার করেন। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের চেয়ারম্যান জাকির হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সপ্তাহ খানেক আগে ওই শিক্ষার্থীর পরিবারের এক সদস্য তাঁর দপ্তরে এসে একই অভিযোগ করেন। কিন্তু শিক্ষার্থীকে ক্লাস থেকে ডেকে এনে জানতে চাইলে সে বিষয়টি অস্বীকার করে।’ এখন আবার কেন এ বিষয়ে নতুন করে ওই শিক্ষার্থী অভিযোগ করছেন, তা তিনি বুঝতে পারছেন না বলে জানান। এ বিষয়ে শিক্ষার্থীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার মা একজন স্কুলশিক্ষক। একজন শিক্ষক আমার অভিযোগের কারণে সমস্যায় পড়বেন তা আমি চাইনি। কিন্তু সে সময় অভিযোগটি না করাকে আমার দুর্বলতা ভেবে তিনি আমার ওপর আবারও চড়াও হন। তাই আমি এ বিষয়ে মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছি।’ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মীজানুর রহমানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওই ছাত্রীর পরীক্ষায় সুযোগ নিয়ে জটিলতার কথা তিনি জানেন। পর্যাপ্ত উপস্থিতি না থাকায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণের বিষয়ে বিভাগীয় শিক্ষক তাকে সুযোগ দিতে অপারগতা জানিয়েছেন। তবে নির্যাতনের বিষয়টি নিয়ে তাঁর কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি বলেও তিনি জানান। অভিযোগকারী ওই ছাত্রী পড়াশোনার পাশাপাশি একটি সংবাদপত্রে কাজ করেন। আবেদনে তিনি অভিযোগ করেন, দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে নানা ধরনের ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলে আসছিলেন ওই শিক্ষক। ইউজিসির কাছে অভিযোগে ওই ছাত্রী উল্লেখ বলেন, বিবিএ পড়ার সময় ২০১১ সালের ১২ নভেম্বর দিবাগত রাত একটা ৫২ মিনিটে ফেসবুক চ্যাটে তাঁকে নক করেন ওই শিক্ষক। এরপর টানা নয় মাস অসংখ্যবার তাঁর সঙ্গে নানাভাবে প্রেমময় ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তায় তাঁকে কাছে টানার চেষ্টা করেন। নানা উপায়ে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও ২০১২ সালের ৫ আগস্ট রাতে ফেসবুকে বাড়াবাড়ি রকমের প্রেমময় ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা বলতে থাকলে বাধ্য হয়ে তিনি ওই শিক্ষককে ফেসবুক থেকে আনফ্রেন্ড করেন। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, বিবিএ ও এমবিএর প্রথম সেমিস্টার শেষ হওয়ায় এমবিএ-দ্বিতীয় সেমিস্টারে ওই শিক্ষকের আরেকটি কোর্স ছিল। তখন ওই শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ফেসবুক ব্যবহার করে পড়ালেখা-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে শেয়ার করার কথা বলায়, ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর তিনি ওই শিক্ষককে ফেসবুকে বন্ধু হওয়ার অনুরোধ পাঠান এবং তিনি (শিক্ষক) তা গ্রহণ করেন। এরপর থেকে আগে কেন তাঁকে আনফ্রেন্ড করা হয়েছিল তা নিয়ে ফেসবুক চ্যাটে অনবরত খোঁচাতে থাকেন। একপর্যায়ে ‘কেউ আমাকে ভালো না বাসলে আমার কিছু করার নাই’ ইত্যাদি ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা বলতে থাকেন। পরে তিনি এক রকম বাধ্য হয়েই ফেসবুকে চ্যাট অপশনটি বন্ধ (অফ) রাখেন। ওই ছাত্রী অভিযোগ করেন, চাকরিজীবী কিংবা কর্মজীবী নারীরা তুলনামূলকভাবে ক্লাসে কম উপস্থিত থাকলে প্রত্যেক শিক্ষকই তাঁদের প্রতি সাধারণত সহানুভূতিশীল থাকেন। কিন্তু জহীর উদ্দিন তাঁর ব্যাপারে অতিরিক্ত কড়া আচরণ শুরু করেন, এমনকি শ্রেণীকক্ষেও তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। এ অবস্থায় তাঁর চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ওই বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, এর আগের সেমিস্টারে একই ব্যাচের ছাত্র শিবিরকর্মী মাসুদ রহমান (রোল: আর-এম-১২০-২০-৪০-০৬) সেমিস্টারজুড়ে কারাভোগ করায় ১০ শতাংশেরও কম উপস্থিতি নিয়ে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। আর ৪০ শতাংশ উপস্থিতি নিয়েও কেবল একজন শিক্ষকের কারণে ওই শিক্ষার্থী এমবিএ চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছেন না। ওই বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষা কমিটির বৈঠকে এমবিএ শিক্ষার্থীদের জন্য ক্লাসে উপস্থিতির বিষয়টি প্রত্যেক শিক্ষক সহানুভুতির দৃষ্টিতে নিলেও, একমাত্র জহীর উদ্দিন আরিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানাবিধ আইন-কানুনের কথা বলে এটিকে ইস্যু করে তোলেন। অভিযোগকারী ওই শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে জানান, লেখাপড়ার স্বার্থে দীর্ঘদিন ওই শিক্ষকের বাড়াবাড়ি সহ্য করলেও এখন বাধ্য হয়ে অভিযোগ করেছেন। অভিযোগ আবেদনের সঙ্গে জহীরউদ্দিন আরিফের পুরো ফেসবুক কথোপকথন সিডি করে জমা দিয়েছেন।