প্রধানমন্ত্রী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছেন!

0
179
Print Friendly, PDF & Email

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতিতে চরম অস্বস্তিতে রয়েছে সরকার। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে অব্যাহত গুম-খুন নিয়ে বিপাকে পড়েছেন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মুখেও উঠে আসছে নানা কথা। দফায় দফায় বৈঠক করছেন প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। গতকাল মন্ত্রিসভার বৈঠকে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সভায় উপস্থিত প্রায় সব মন্ত্রীই বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে এনে বলেন, এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া না হলে জনমনে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। এ পরিস্থিতির জন্য খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দলের একাধিক নেতা সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপিকে দায়ী করে বক্তব্য রাখলেও অনেকে আবার সরকারেরও সমালোচনা করছেন।
গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর মহামারি আকার ধারণ করা এ ইস্যুটি নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে সরকার ও দলের ভেতরে-বাইরে। এ পরিস্থিতিতে সরকারদলীয় অনেক নেতাকর্মীও নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। এমন প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে ব্যর্থ দাবি করে তার পদত্যাগ নিয়েও নানা গুঞ্জন চলছে সরকারে। আবার নিজের হাত থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে সেখানে পূর্ণ মন্ত্রী দেয়ার ব্যাপারেও প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত গতকাল এক আলোচনাসভায় বলেছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনো ‘প্রক্সি’র জায়গা নয়, এখানে আইন জানা ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোকদের ফুল মন্ত্রিত্ব দিয়ে চালাতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে গুম-খুনের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, গুম-খুন কোনো সুখকর বিষয় নয়। সাম্প্রতি এটি সীমা অতিক্রম করে গেছে। এটি মেনে নেয়া যায় না। এর বিরুদ্ধে সরকারকে আরো সোচ্চার হতে হবে।
নারায়ণগঞ্জের হত্যাকাণ্ডের দায় সরকার এড়াতে পারে না উল্লেখ করে সুরঞ্জিত আরো বলেন, এই হত্যার সাথে মতাশীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয় থাকা অস্বাভাবিক নয়।
দলের প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, গুম-খুনের দায় সরকার কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। তবে অচিরেই গুম-খুন-অপহরণ বন্ধ হবে। এসব ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পুলিশের হিসাবে, গত তিন মাসে ঢাকায় ৫০টিসহ সারা দেশে ১৯৬টি অপহরণের মামলা হয়েছে। একই সময় ১২৯০টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। অপহৃতদের বেশির ভাগকে পুলিশ উদ্ধার করতে পারেনি। যাদের অনেককে আবার ফিরতে হয়েছে লাশ হয়ে। এর মধ্যে সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাতজন অপহরণের পর শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তাদের লাশ উদ্ধারের ঘটনা দেশব্যাপী ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, দলের সর্বোচ্চ মহল থেকে গুম-খুনের দায়ভার বিএনপির ওপর চাপানোর চেষ্টা করা হলেও বিষয়টি নিয়ে মোটেও স্বস্তিতে নেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সরকারের জন্য এটি এখন ‘বার্নিং ইস্যু’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গুম-খুনে শুধু সরকারবিরোধী নেতাকর্মীই নন, ব্যবসায়ী, শিক্ষকসহ সাধারণ মানুষও এর শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জে গুম, খুন ও নৃশংসতার শিকার হওয়া প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। তাই ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তারাও। দল ও সরকারের বিভিন্ন ফোরামে বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সাথে আলোচনা হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি কপোরেশনের প্যানেল মেয়রসহ সাতজনকে অপহরণের পর খুনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে গতকাল মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দেয়া হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী নিজেই নারায়ণগঞ্জের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সার্বণিক পর্যবেণ করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিচ্ছেন বলে জানানো হয়েছে।
এর আগে গত শনিবার দলের সংসদীয় বোর্ডের বৈঠকেও অপ্রাসঙ্গিকভাবে বিষয়টি আলোচনায় উঠে এলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী এসব বিষয় নিয়ে সিনিয়র মন্ত্রী ও নেতাদের সাথে একাধিকবার বৈঠক করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য এ প্রতিবেদককে বলেন, দেশে যখন আন্দোলন ও রাজনৈতিক তেমন কোনো ইস্যু নেই ঠিক তখনই এ গুম-খুন নিয়ে সরকার বেশ বিপাকে। বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর দায় চাপানো রাজনৈতিক কৌশল হলেও আসলে কারা এসব করছে তা নিয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। সরকারকে বিপদে ফেলতে কেউ এসব করে থাকতে পারে। এ অবস্থায় দেশের কোনো মানুষই নিরাপদ বোধ করছে না। তাই গুম-খুনের বিরুদ্ধে সরকারকে আরো কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। না হলে দেশের মানুষ ুব্ধ হয়ে রাজপথে নামতে পারে। যা সরকারের জন্য মোটেও কল্যাণকর হবে না।
আরেক নেতার মতে, ৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ নির্বাচনের মাধ্যমে এ সরকার ক্ষমতায় এলেও এখন সরকারের সামনে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। সরকারবিরোধী বিএনপি জোটও এ সরকারকে নানাভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। তারা এখন পর্যন্ত সরকারবিরোধী কোনো কর্মসূচি পালন করেনি। দেশে এখন কোনো রাজনৈতিক ইস্যু নেই। আর দেশে যখন এ রকম শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছে ঠিক তখন গুম-খুন একটি সন্দেহজনক বিষয়। এটি নিয়ে সরকার বেশ চিন্তিত।
কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্য জানান, গুম-খুন নিয়ে সরকার অনেকটাই অন্ধকারে। বিষয়টি সরকারের বিভিন্ন ফোরামে বেশ গুরুত্বের সাথে আলোচনা চলছে। কিভাবে এ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটানো যায় তা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। তবে এ নেতার মতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানে না এমন কোনো ঘটনা ঘটতে পারে না। আর ঘটলেও তা মুহূর্তের মধ্যেই তাদের নখ দর্পণে চলে আসে। তাই যে দল বা মতের লোকই গুম হোক না কেন এটি নিয়ে সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেয়ালি করা ঠিক নয়। এর হোতাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা উচিত।
এ দিকে দল ও সরকারের নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানায়, গুম-খুনকে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বেশ গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর তা বেড়ে যাওয়ায় চরম বিপাকে সরকার। এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে প্রধানমন্ত্রী স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে ইতোমধ্যেই কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছেড়ে একজনকে পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়ার কথা ভাবছেন। যেকোনো সময় এ সিদ্ধান্ত আলোর মুখ দেখতে পারে বলে সূত্রগুলো জানায়।

শেয়ার করুন