১০ মিনিটেই ছত্রভঙ্গ হেফাজতের সমাবেশ

0
210
Print Friendly, PDF & Email

ঘুটঘুটে অন্ধকার। হাঁটতে গেলেই পায়ের নিচে পড়ছে ভাঙা কাচ, ইটের টুকরা। পুড়ে যাওয়া ভবনগুলো থেকে তাপ বেরুচ্ছে। রাস্তায় এদিক-সেদিক পড়ে আছে পুড়ে যাওয়া বাস, গাড়ি। ফুটপাত ব্যবসায়ীদের অস্থায়ী অগ্নিদগ্ধ দোকানের কোনো মালামাল থেকে ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে। ভস্মীভূত মালামাল থেকে বেরুচ্ছে ধোঁয়া। চারদিকে পোড়া গন্ধ। আগুন নেভাতে পানি নিয়ে চলছে ছোটাছুটি। সাইরেন বাজিয়ে ছুটছে দমকল বাহিনীর গাড়ি। মুখ থুবড়ে পড়ে আছে লাইট পোস্ট। রাস্তার মাঝের ডিভাইডারের গাছগুলোর ওপর দিয়ে যেন ঝড় বয়ে গেছে। শত শত বড় গাছ পড়ে আছে রাস্তার ওপর।

এটা যুদ্ধবিধ্বস্ত কোনো নগরীর চিত্র নয়। খোদ রাজধানী ঢাকার মতিঝিলের দৃশ্য এটি। গত বছরের এই দিনে হেফাজতে ইসলামীর ঢাকা অবস্থান কর্মসূচিতে রাজধানী ঢাকাকে এমনই মৃত্যুপুরি বানানো হয়েছিল। বিশেষ করে প্রেসক্লাব থেকে মতিঝিল পর্যন্ত সড়ক চলে গিয়েছিল হামলাকারীদের নিয়ন্ত্রণে। রাতের ঢাকা হয়ে উঠেছিল ভয়ঙ্কর। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফ থেকে বারবার হেফাজতের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের ওই এলাকা ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছিল। কিন্তু হেফাজতের পক্ষ থেকে এ আহ্বানে সাড়া দেওয়া হয়নি। এর পরই মতিঝিল শাপলা চত্বরে অবস্থান নেওয়া হেফাজতে ইসলামের অর্ধলক্ষ কর্মীকে সরিয়ে নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেই রাতে নতুন এক অভিযান চালানোর পরিকল্পনা নেয়। মধ্যরাতে মাত্র ১০ মিনিটের এক শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে শাপলা চত্বর থেকে অর্ধলক্ষ মানুষের জমায়েত ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ফাঁকা হয়ে যায় গোটা মতিঝিল। অপারেশন ‘শাপলা’ নামের ওই অভিযানে অংশ নেয় র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবির ১০ হাজার সদস্য।

অভিযান ‘শাপলা’ : মাত্র ১০ মিনিটের সেই অভিযান। প্রায় অর্ধলক্ষ হেফাজত কর্মীকে শাপলা চত্বর থেকে ছত্রভঙ্গ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচালনা করে অন্যরকম এক অভিযান। প্রায় ১০ হাজার পুলিশ সদস্যের সঙ্গে অভিযানে অংশ নেয় র‌্যাব গোয়েন্দা ইউনিট ও র‌্যাব-৩ এর সমন্বয়ে গঠিত ৮০০ সদস্যের একটি দল। ছিল বিজিবির ৩২ প্লাটুন সদস্য। অভিযানে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সাতজন। এ ছাড়া হেফাজত কর্মীদের হামলায় একজন সাব-ইন্সপেক্টর নিহত হয়েছেন। হেফাজত কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে গিয়ে পুলিশের গুলি ও রাবার বুলেটে বহু হেফাজত কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। হেফাজতের হামলায় অন্তত অর্ধশত পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হন। মতিঝিল শাপলা চত্বরে গভীর রাতে অভিযানে সরাসরি অংশ নেন ডিএমপির একজন অতিরিক্ত কমিশনার, দুজন উপ-কমিশনার, দুজন অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ও চারজন সহকারী কমিশনারের নেতৃত্বে ১০ হাজার পুলিশ সদস্য। মোতায়েন করা হয় ছয়টি এপিসি ও দুটি জলকামান। ব্যবহার করা হয় রাইফেল, শটগান, গ্যাস গান ও সাউন্ড গ্রেনেড। এর আগে হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের সমাবেশস্থল ত্যাগ করার জন্য শাপলা চত্বর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনের রাস্তা এবং ইত্তেফাক মোড়ের দিকের রাস্তা দুটি উন্মুক্ত করে দেয় পুলিশ। রাত সোয়া ২টার দিকে মতিঝিল থানার সামনে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার শেখ মারুফ হাসান হেফাজত কর্মীদের সমাবেশস্থল থেকে সরে যাওয়ার অনুরোধ করেন। মাইকিং করে তিনি বলেন, সরে না গেলে সমাবেশকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ঘোষণার পর পুলিশ ২০ মিনিট অপেক্ষা করে। রাত ২টা ৩৫ মিনিটে পুলিশ আনুষ্ঠানিকভাবে হেফাজত কর্মীদের লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। হেফাজত কর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ও পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে। একই সময়ে আরামবাগ ও দিলকুশার দিক থেকে পুলিশ ফাঁকা গুলি, রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করতে থাকে। বৃষ্টির মতো সাউন্ড গেনেড ফাটাতে থাকে। একপর্যায়ে হেফাজত কর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছু হটতে থাকে। অন্যদিকে মতিঝিল থানার গলির দক্ষিণ দিক থেকে হেফাজতে ইসলামের একদল কর্মী থানা লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। এ সময় পুলিশ হেফাজত কর্মীদের লক্ষ্য করে শত শত রাউন্ড টিয়ার শেল ছুড়তে থাকে। টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় অনেক পুলিশও অসুস্থ হয়ে পড়েন। পুলিশ মতিঝিলের জনতা ব্যাংক ভবনের দিক থেকে দুটি এপিসি নিয়ে হেফাজত কর্মীদের দিকে রাবার বুলেট ছুড়তে থাকে। এ সময় কয়েকজন হেফাজত কর্মী পুলিশের রাবার বুলেটে রাস্তায় লুটিয়ে পড়লে কর্মীদের মনোবল ভেঙে যায়। তারা একযোগে পিছু হটে আশপাশের ভবনে আত্দগোপন করেন। পুলিশ ফাঁকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়। এ সময় নটর ডেম কলেজের দিক থেকে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণ করতে করতে সেখানে উপস্থিত হয়। এরই মধ্যে হেফাজতের প্রায় সব নেতা-কর্মী শাপলা চত্বর থেকে ইত্তেফাকের মোড় দিয়ে যাত্রাবাড়ীর দিকে দৌড়াতে শুরু করেন। যেসব হেফাজত কর্মী বিভিন্ন ভবনে আত্মগোপন করেন, তাদের র‌্যাব সদস্যরা উদ্ধার করে ছেড়ে দেন। এদের মধ্যে সোনালী ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ের সীমানা প্রাচীর টপকে প্রায় তিন হাজার কর্মী সেখানে আত্দরক্ষা করেছিলেন। র‌্যাব সদস্যরা সেখান থেকে তাদের উদ্ধার করে ছেড়ে দেন। হেফাজত কর্মীদের সবার চোখে-মুখে ছিল এক আতঙ্কের ছাপ।

শেয়ার করুন