নদীর কিনার থেকে নির্জন মাঠ, এক হাসপাতালের মর্গ থেকে আরেক হাসপাতালের মর্গ- অপহৃত স্বজনের খোঁজে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটছে উদ্বিগ্ন মানুষ। বাবা ছুটছেন প্রিয় সন্তানের লাশ শনাক্ত করতে, স্ত্রী যাচ্ছেন প্রিয়তম স্বামীর লাশ খুঁজে পেতে। এমন অসহনীয় দিন পার করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নামে অপহৃতদের স্বজনরা। এ মুহূর্তে সারা দেশের চিত্র এটি। নারায়ণগঞ্জে ঘটে যাওয়া সাতজন অপহরণের পর খুনের ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে তা এখন দেশের প্রায় সর্বত্র। এ আতঙ্ক রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যে। রাজধানীতে পথ চলতে পাশের লোককেও যেন বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। মাইক্রোবাস দেখলেই সেখান থেকে নিরাপদে সরে যাচ্ছেন পথচারীরা। কয়েকটি ঘটনায় অবশ্য অপহৃতদের উদ্ধারও করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গ্রেফতার করেছে অপহরণকারীর মূল হোতাকে। এর পরেও আতঙ্ক কাটছে না। আতঙ্কে ভরা এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে রাজনৈতিক দল, সাধারণ মানুষ আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ঘুরে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেশের বিশিষ্টজনদের। তারা বলছেন, এ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো বিভেদ থাকা চলবে না। পাল্টাপাল্টি দোষারোপ বন্ধ করতে হবে। তা না হলে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অপরাধীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন তারা। প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক মনে করেন, বর্তমানে যেভাবে গুম-খুন বাড়ছে, যেখানে সেখানে লাশ পাওয়া যাচ্ছে- এতে দেশের চরিত্রই পাল্টে দিয়েছে। এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবশ্যই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তার মন্ত্রণালয়ের দৃশ্যমান কোনো কাজ দেখা যাচ্ছে না। এভাবে দেশ চলতে পারে না। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত হবে, এসব ঘটনায় যারাই জড়িত থাক না কেন, তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতাও রয়েছে। তাদের আরও সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে হবে। সমাজের বিশিষ্টজনসহ সব নাগরিকের উচিত হবে, গুম-খুনের তীব্র প্রতিবাদ করা। এর বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ এস এম শাহজাহান বলেন, রাজনৈতিক দল, সাধারণ মানুষ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর ব্লেম গেমের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সঠিকভাবে তদন্ত করে আসামি গ্রেফতারে পুলিশকে সহায়তা করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও এখন মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। আর এ জন্য প্রকৃত আসামি যারাই হোক, গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় এ পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করেন পুলিশের সাবেক এই প্রধান। সাবেক আইজি বলেন, ১৬ কোটি মানুষের চেয়ে মুষ্টিমেয় গুটিকয় অপরাধী কখনই শক্তিশালী হতে পারে না। এ জন্য সাধারণ মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত না হয়ে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। সরকারেরও সদিচ্ছা থাকতে হবে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দলমত নির্বিশেষে প্রত্যেককে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। আইনের হাত লম্বা, তা প্রমাণ করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেক সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, গুম-অপহরণ হঠাৎ করেই বাড়েনি, দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। এটা দুই কারণে হতে পারে। একটি হলো প্রশাসনের অবক্ষয়ের কারণে। অন্যটি রাজনৈতিক কারণে। তাই অপহরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে প্রশাসনকে আরও বেশি তৎপর হতে হবে। সরকারকে আরও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। একইভাবে রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে এর প্রতিবাদে সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে হবে।
পরস্পর দোষারোপ না করে গুম-খুনে জড়িতদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, এরকম একটি বিষয় নিয়ে যদি শুধু রাজনৈতিক খেলা চলতে থাকে, তাহলে সমস্যার উত্তরণ সম্ভব হবে না। পারস্পরিক দোষারোপ সমস্যার সমাধান না। মানুষ অপহৃত হচ্ছে, গুম হচ্ছে, নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা খুব একটা দৃশ্যমান হচ্ছে না।
সরকারের উদ্দেশে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, শর্ষের ভিতরই ভূত রয়েছে। আগে সে ভূতটি চিহ্নিত করুন। ‘চাটুকারদের’ কাছ থেকে দূরে থাকতে প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দেন তিনি। বলেন, চাটুকাররা যেন আপনাকে ভুল তথ্য দিয়ে বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে না রাখতে পারে। নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আপনাদের দায়িত্ব। গুম-খুন নিয়ে খালেদা জিয়ার ‘রেড অ্যালার্ট’ এবং শুধু নেতা-কর্মীদের সতর্ক করে বিএনপির পরামর্শের সমালোচনা করেন মিজান। বলেন, আমি বিস্মিত হই যে একটি জাতীয় রাজনৈতিক দল কী করে জনগণের কথা না ভেবে শুধু নিজেদের স্বার্থের কথা ভাবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, সরকার মনে হয় নাকে তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছে। তাদের উদ্বিগ্ন কিংবা চিন্তিত হতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে গুম-খুনের মাত্রা আরও বেড়ে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সন্ত্রাসী কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া হচ্ছে। এভাবে দেশ চলতে পারে না।
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেন, গুম, খুন ও অপহরণ রোধে প্রয়োজন রুল অব লর বাস্তবায়ন। প্রয়োজনে রাষ্ট্র, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গণমাধ্যম, আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে রুল অব ল বাস্তবায়নে মার্চ করা উচিত। এর নাম দেওয়া হবে ‘মার্চ ফর রুল অব ল অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’। নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে গ্রাম-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে পোস্টার, লিফলেটসহ নানা প্রচারসামগ্রী বিতরণ করা উচিত। সবাই সচেতন হলেই কেবল এসব অপরাধপ্রবণতা কমতে পারে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম বলেন, অপহরণের ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অ্যাকশনে চলে যেতে হবে। এখন যে অ্যাকশন নেওয়া হচ্ছে, তা আরও আগে নেওয়া উচিত ছিল। তাহলে হয়তো একটা জীবন রক্ষা করা সম্ভব। এলাকায় এলাকায় প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা যেতে পারেও বলে মত দেন তিনি।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী বলেন, গুম, খুন ও অপহরণের ঘটনায় সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি রাজনৈতিক দল ও সমাজের বিশিষ্টজনদের ব্যর্থতা রয়েছে। সরকারের ব্যর্থতা হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের মদদেই এসব ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে তারা এসব করছে। অনেক ক্ষেত্রে সরকারী দলের দুই পক্ষের প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে এসব ঘটনা ঘটছে। ফলে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব বিষয় দেখেও না দেখার ভান করছে। সরকার ও আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর উচিত হবে_এ ঘটনা আর বাড়তে দেওয়া যাবে না।
টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের মতে, গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন দেশে জনগণের নিরাপত্তা না থাকার বিষয়টি আমাদের জন্য উদ্বেগজনক। কিন্তু বর্তমানে কি কারণে গুম ও অপহরনের মত ঘটনাগুলো ঘটছে তা বোধগম্য নয়। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ধারক ও বাহক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কর্মকান্ডে আমরা হতাশ। আমরা যখন দেশের এ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে মানববন্ধন করতে চাইলাম সে সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমাদের বাধা দিল।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বাংলাদেশে এখন বিরোধী দল বলতে কিছু নেই। ফলে রাজনৈতিকভাবেও সেভাবে প্রতিবাদ আসছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ হলো অপরাধ দমন করা। কিন্তু অভিযোগের তীর তাদের দিকেই। তাই তাদেরই উচিত হবে, এগুলো মিথ্যা প্রমাণ করা।