স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের জ্ঞাতসারেই চার সহযোগীসহ খুন হয়ে গেলেন নারায়ণগঞ্জের সিটি কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম। খুন হওয়ার আগে তিনি অপহূত হয়েছেন। তারও দুই সপ্তাহ আগে তিনি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাসায় গিয়ে তাঁকে বলেছিলেন, তাঁকে হত্যা করা হবে। যারা তাঁকে হত্যা করতে চায়, তাদের নামও তিনি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে বলেছিলেন।
তার সপ্তাহ দুই পর চার সহযোগীসহ সত্যিই অপহূত হলেন কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম। এবার তাঁর স্বজনেরা কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে হাজির হলেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাসায়। নজরুলের বৃদ্ধ মা মন্ত্রীর কাছে আকুতি জানালেন, ‘বাবা, যে করেই হোক, আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দেন।’ কিন্তু নজরুল জীবিত ফিরে এলেন না। অপহূত আরও ছয়জনের সঙ্গে তিনিও লাশ হয়ে ভাসলেন শীতলক্ষ্যা নদীতে। অতঃপর আমাদের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য: ‘আমার কাছে নজরুল এসেছিল, নামও বলে গিয়েছিল। আবার সকালে তার ছেলেমেয়েগুলো এসে কান্নাকাটি করে গেল। সবাই ভালো ছাত্রছাত্রী, জিপিএ-৫ পাওয়া। আমি এখন তাদের কাছে গিয়ে কী বলব?’
আহা! বেচারা স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী! তিনি এখন নজরুলের বৃদ্ধ মা ও ছেলেমেয়েগুলোকে কী বলে সান্ত্বনা দেবেন? কোনো সান্ত্বনা কি আছে? না, নেই। যাদের হাতে নজরুলের মৃত্যু অনিবার্য হয়ে উঠেছিল, তাদের কাছে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ক্ষমতা নির্দয়ভাবে অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে; তারা তাঁর অসহায়ত্ব দেশবাসীর সামনে প্রকটভাবে তুলে ধরেছে। সাত ব্যক্তির অপহরণের পর প্রতিমন্ত্রী পুলিশের মহাপরিদর্শক ও র্যাবের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তাকে ফোন করে পদক্ষেপ নিতে বলেছিলেন। কিন্তু তার কোনো ফল ফলেনি। সাত অপহূতের লাশ ভেসে উঠেছে শীতলক্ষ্যার বুকে। ব্যাপারটা এমনভাবে ঘটল যেন সবার চোখের সামনেই সাতজন মানুষকে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হলো, কারোরই কিছু করার থাকল না।
জনগণের নিরাপত্তা বিধান ও আইন প্রয়োগ ব্যবস্থার অকার্যকারিতা প্রতিমন্ত্রীর নিজের বক্তব্যেও স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, সাত ব্যক্তির অপহরণ ও হত্যার পর আসামিদের ধরার ব্যাপারে সরকারের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। শুরু থেকেই বিষয়টিকে নাকি অনেক গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্য কিছু সূত্রে সংবাদমাধ্যম জানতে পেরেছে, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অপহরণকারীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। তিনি অপেক্ষা করছিলেন ‘ওপরের নির্দেশনা’র। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে ভুগতে তিনি সংবাদমাধ্যমকে বারবার বলছিলেন যে তিনি চেষ্টার কোনো ত্রুটি করছেন না। তারপর, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গণভবন থেকে বেরিয়ে এসে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী আসামিদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন। দু-এক দিনের মধ্যেই ‘বড় একটা কিছু হবে’।
কিন্তু এক সপ্তাহেও সেই ‘বড় একটা কিছু’ ঘটল না। এর মধ্যেই নারায়ণগঞ্জে অপহূত হলেন আরও এক ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম এবং ২৪ ঘণ্টা পর তিনি ফিরে এলেন। এটা নিশ্চয়ই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বর্ণিত সেই ‘বড় একটা কিছু’ নয়। এবং এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা গোয়েন্দাদের কোনো কৃতিত্ব নেই; কারণ যারা তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিল, তারাই তাঁকে ছেড়ে দিয়েছে। এমন নয় যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে তাঁকে উদ্ধার করেছে, কিংবা অপহরণকারীদের কাউকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে।
অপহরণ, খুন ও গুম থেকে মানুষকে বাঁচানো দূরের কথা; এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা আরও দূরের কথা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কোনো ঘটনারই কোনো কূলকিনারা করতে পারছে না। কাউন্সিলর নজরুলসহ সাতজনের অপহরণ ও হত্যার পর এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেল, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ সত্ত্বেও খুনি অপহরণকারীদের গ্রেপ্তার করা দূরে থাক, এ ঘটনার কোনো কূলকিনারাই করতে পারেনি প্রশাসন। এই অবস্থায় আরও আজব আজব কথা বলছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। যেমন, শুক্রবার তিনি বললেন, পরিস্থিতি শান্ত না হলে কোনো আসামিকেই গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না। এই কথার মানে কী? ‘পরিস্থিতি’ বলতে কী বোঝাচ্ছেন তিনি? একের পর এক অপহরণ, খুন ও গুমের ঘটনায় দেশজুড়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, সেটাই কি তিনি বোঝাতে চাইছেন? তা-ই যদি বোঝাতে চান, তাহলে এই পরিস্থিতি শান্ত হবে কীভাবে? কে কোথা থেকে এসে তা শান্ত করে দিয়ে যাবে? স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কি বলতে চাইছেন, যারা অপহরণ-খুন-গুমের মচ্ছবে নেমেছে তারা আপনা-আপনি থেমে যাবে এবং পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসবে? আর কেবল তখনই