নারায়ণগঞ্জে প্যানেল মেয়র নজরুলসহ ৭ খুনের নেপথ্যে আওয়ামী দুই গ্রুপের দেড় যুগের আধিপত্যের লড়াই

0
199
Print Friendly, PDF & Email

রাজধানীর নিকটবর্তী নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের দুপক্ষের দেড় যুগ ধরে আধিপত্যের লড়াইয়ের জের ধরে অপহরণের পর নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন  নারায়ণগঞ্জ সিটি কপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নজরুল ইসলামসহ ৭ জন। এঘটনায় মামলার আসামীরা সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা। এলাকাবাসীর সাথে আলাপকালে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

এদিকে অপহৃত ৭ জনের লাশ উদ্ধারের ২ দিন পার হলেও মামলায় অভিযুক্ত কোনো আসামীকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এরইমধ্যে আসামী গ্রেফতার না হওয়ায় বিক্ষুদ্ধ জনতা প্যানল মেয়র হত্যা মামলার প্রধান আসামী সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নুর হোসেনের শিমরাইল মোড়ে অবস্থিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এবং ২য় আসামী থানা আওয়ামী লীগের  সাধারণ সম্পাদক হাজী ইয়াসিনের বাড়িতে আগুন দিয়েছে

জানা গেছে, প্যানেল মেয়রের সাথে অপহরণের পর নৃশংস খুনের শিকার এডভোকেট চন্দন সরকারের হত্যার প্রতিবাদে কাল রোববার হরতাল ডেকেছে জেলা আইনজীবিরা। এ হরতালে সমর্থন দিয়েছে জেলা Ÿিএনপি ও সিপিবি। ৭ খুনের ঘটনায় আতংক ছড়িয়ে পড়েছে জেলার সর্বত্র।

ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি গোলাম ফারুক জানান, নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর ৭ হত্যাকা-ের আসামী গ্রেফতারে এখনও পর্যন্ত তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।

নারায়ণগঞ্জেই গুম-অপহরণের মতো ঘটনা ঘটছে কেন?

এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জে এখন অনেকগুলো প্রতিপক্ষ এক ঢিলে বহুপাখি মারতে চেষ্টা করছে। যে কারণে একের পর এক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।

স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, পরিস্থিতি শান্ত না হলে আমরা কোনো আসামিকেই গ্রেপ্তার করতে পারছি না। মন্ত্রী বলেন, আমরা বুঝতে পারছি যে দু-চারজন আসামিকে ধরতে পারলে পরিস্থিতি শান্ত হতো। কিন্তু যাদের ধরতে চাচ্ছি, তারাও তো আর লোক-সম্মুখে নেই। অনেকেই আত্মগোপনে চলে গেছে। তবে শিগগির পরিস্থিতি শান্ত হবে বলে জানান তিনি।

৭ খুনের নেপথ্যে

দেড় যুগ ধরে প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ নেতা নুর হোসেনের সাথে দ্বন্ধ চলে আসছিল প্যানেল মেয়র নজরুলের। আধিপত্য বিস্তার এবং সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল এলাকায় পরিবহন সেক্টর, শীতলক্ষা নদীর তীরে বালু ব্যবসা, মাদক ব্যবসাসহ একধিক অবৈধ কোটি কোটি টাকা আয়ের খাত নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নুর হোসেনের সাথে চরম বিরোধ চলে আসছিল নজরুলের। ১৯৯২ সাল থেকে দ্বন্দ্বটা শুরু হলেও তা প্রকট হতে থাকে ৯৮ সালের দিকে। তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। ১৯৯২ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ ইউপির চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হন নূর হোসেনসহ ১৩ জন। শক্তিশালী প্রার্থী সাবেক চেয়ারম্যান সহিদুল ইসলামকে পরাজিত করে দুই থেকে আড়াইশ’ ভোটের ব্যবধানে নূর হোসেন জয়ী হন। এরপর প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন পুরো সিদ্ধিরগঞ্জে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হন নূর হোসেন। আওয়ামী লীগ থেকে শামীম ওসমান প্রার্থী দেন নজরুলকে। তখন নজরুল হেরে যায়।

২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর দেশ ছেড়ে ভারতে আত্মগোপন করেন নূর হোসেন। মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ৫ জুন তিনি দুই-তিনশ’ কর্মী-সমর্থক নিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ আসেন। ২০০৭ সালের ১২ এপ্রিল আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল নূর হোসেনের বিরুদ্ধে রেড ওয়ারেন্ট জারি করে। ২০১১ সালের মার্চে আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতার তদবিরে ওয়ারেন্ট প্রত্যাহার করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। একই সময় নজরুলও এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং আওয়ামী লীগ গত মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর নজরুল সিদ্ধিরগঞ্জে ফিরে এলেও আগের অবস্থান থেকে ছিটকে পড়ে। সিদ্ধিরগঞ্জের নিয়ন্ত্রণ নেয় নুর হোসেন।  তিনি শামীম ওসমানের সাথে তার সখ্যতা আরো গভীর করে তোলে।

জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ সিটি কপোরেশন নির্বাচনে শামীম ওসমানের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে নির্বাচনে অংশ নেয় নজরুল । তিনি ৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হন এবং ভোট বেশি পাওয়ায় প্যানেল মেয়র নির্বাচিত হন। অপরদিকে ৪ নং ওয়ার্ড থেকে নির্বাচন করে কউন্সিলর নির্বাচিত হন নুর হোসেন।

নির্বাচিত হওয়ার পর নজরুল নারায়ণগঞ্জ ২ আসনের এমপি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাবুর মাধ্যমে মেয়র আইভী বলয়ে চলে যান।  এতে করে শামীম ওসমানের সাথে তার দূরত্ব দেখা দেয়।

নজরুল ইসলামের লাশ উদ্ধারের পর তার ন্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি সাংবাদিকদের কাছে স্পষ্ট করে বলেছেন শামীম ওসমান আমার স্বামীকে খুন করেছে। শামীম ওসমান এ হত্যার সাথে জড়িত বলে তিনি অভিযোগ করেন।

সেলিনা ইসলাম জানান, একই সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর নূর হোসেন ও সিদ্ধিরগঞ্জ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী ইয়াছিনের সাথে রাস্তা নির্মাণ নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। এ ঘটনার পর থেকে নজরুলের বিরুদ্ধে একটি মামলাও দায়ের হয়। পরে নজরুল পলাতক ছিল। ওই মামলায় সে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেয়। উচ্চ আদালতের নির্দেশে নিম্নআদালতে নজরুল হাজিরা দিতে আসে।

তিনি জানান, নারায়াণগঞ্জ আদালতে হাজিরা দেয়ার আগের দিন নজরুল সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের সাথে দেখা করেন এবং আদালতে যাওয়ার কথা জানান। শামীম ওসমানও নজরুলকে অভয় দেয় আদালতে যাওয়ার জন্য।

তবে শামীম ওসমান এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, নজরুল তার কর্মী ছিলেন। এঘটনায় সরকারকে বিব্রত করে কেউ ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করেছে।

নজরুলে জানাযায় মানুষের ঢল

বৃহস্পতিবার দুই দফা জানাযা শেষে দুপুর পৌনে ১২টার দিকে স্থানীয় মিজমিজি পশ্চিমপাড়া কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। এর আগে সকাল পৌনে ১১টার দিকে সিদ্ধিরগঞ্জের মৌচাক এলাকায় মহাসড়কে মরহুমের দ্বিতীয় জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জানাযা পড়ান স্থানীয় মসজিদের ইমাম আবদুল আউয়াল। এ সময় নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের পাশাপাশি অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। আর এতে করে সৃষ্টি হয় অনেকটা আবেগঘন পরিবেশের।

এ সময় প্যানেল মেয়র-১ ওবায়েদুল্লা, কাউন্সিলর কামরুল হাসান মুন্না, মাকসুদুল আলম খন্দকার, আলমগীর ইসলাম, হান্নান সরকার, জমসের আলী ঝন্টুসহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া জানাযার নামাযে অংশ না নিলেও পাশেই উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভী এবং নারী প্যানেল মেয়র ও নারী কাউন্সিলররা। তবে জানাযায় শামীম ওসমান উপস্থিত ছিলেন না। পরে তাকে মিজমিজি পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। এদিকে নজরুলের সাথে নৃশংস খুনের শিকার তাজুল জাহাঙ্গীরসহ বাকীদেরও জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন এবং এডভোকেট চন্দন সরকারের সৎকার সম্পন্ন করা হয়।

আসামীদের অফিস ও বাসভবন ভাঙচুর আগুন

প্যানেল  মেয়র নজরুল ইসলামকে অপহরণ ও হত্যা মামলার অন্যতম আসামি আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেনের কার্যালয়ে এবং ২য় আসামী হাজী ইয়াসিনের বাড়ি ভাঙচুর করে আগুন দিয়েছে বিক্ষুব্ধরা। বিক্ষুব্ধরা এ সময় ডিজিটাল ব্যানার এবং কার্যালয়ের বিভিন্ন আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে সিদ্ধিরগঞ্জে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় বিক্ষুব্ধরা ওই কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং সন্ধ্যায় হাজী ইয়াসিনের বাড়িতে আগুন দেয়।

চন্দন সরকারের বাসভবনে ড. শাহদীন মালিক

অপহরণের পর নৃশংস খুনের শিকার নারায়ণগঞ্জ আইনজীবি সমিতির সদস্য চন্দন সরকারের বাসভনে তার পরিবারকে শান্ত¦না দিতে গতকাল সিদ্ধিরগঞ্জের জালকুড়িতে চন্দন সরকারের বাসভবনে গিয়েছেন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ড.শাহদীন মালিক। তিনি এসময় সাংবাদিকদের জানান, নারায়ণগঞ্জের আইনশ্ঙ্খৃলা বাহিনীর উপর থেকে সাধারণ মানুষের আস্থা চলে গেছে। এজন্য এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সকল কর্মকর্তা কর্মচারীর প্রত্যাহার দাবি  করেন তিনি। আইন অনুযায়ী র‌্যাবের গ্রেফতার করার কোনো ক্ষমতা নেই বলে দাবি তার।

থমথমে নারায়ণগঞ্জ

এখনো থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে নারায়ণগঞ্জে। জেলার প্রধান সড়কে টহল দিচ্ছে র‌্যাব পুলিশ আর বিজিবি। মানুষের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। দোকান-পাঠ অধিকাংশই বন্ধ। সাধারণ মানুষের একটাই প্রশ্ন কি হচ্ছে ? এভাবে আর কতো মানুষ খুন হবে।

মৃত্যুর আগে নজরুলের আকুতি

বেশ কিছুদিন ধরে প্যানেল মেয়র নজরুলকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছে দুর্বৃত্তরা। তিনি এ বিষয়টি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকেও জানিয়েছেন। এমনকি মেয়র আইভী শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেনকে বিষয়টি জানিয়েছেন।  সর্বোপরি তিনি স্মরণাপন্ন হয়েছিলেন শামীম ওসমানের। এমনকি অপহরণের দিন গত ২৭ এপ্রিল আদালতে হাজিরা দেয়ার আগেও তিনি শামীম ওসমানকে জানিয়েছেন তাকে হত্যার চেষ্টা চলেছে। কিন্ত শেষ পর্যন্ত তাকে অপহরণের পর নৃশসংভাবে খুন করে দুর্বৃত্তরা।

উল্লেখ্য, গত ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ আদালত থেকে মামলার হাজিরাশেষে সিদ্ধিরগঞ্জ বাসায় যাওয়ার পথে শিবু মার্কেট এলাকায় নজরুলসহ ৫ জন এবং একই সময়ে আইনজীবী চন্দনসরকারও তার গাড়ির ড্রাইভারকে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা। ৩০ এপ্রিল বিকেলে শীতলক্ষা নদীতে বন্দর কলাগাছিয়া এলাকায় তার লাশ পাওয়া যায়।

শেয়ার করুন