আমরা চাকরিজীবী দম্পতি

0
165
Print Friendly, PDF & Email

সন্ধ্যার খানিক আগে-পরে দুজনেই অফিসফেরত। ঘরের কাজ, বাজার করা, রাতের খাবার, সকালের নাশতা, ছেলের স্কুল আরও কত কী! দুজনেই যখন চাকরিজীবী তখন কীভাবে সামলাবেন এতসব! হাসি-কান্নায় মিলেমিশে সব সামলানোর এই শিল্পের নামই তো সংসার। শিল্পী স্বামী-স্ত্রী দুজনই। যাঁর যাঁর ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক কাজকর্ম আর সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব ভাগ করে নিয়ে ব্যস্ততায় ভালোবাসায় একসঙ্গে পথচলাটাই দাম্পত্য।

আমরা চাকরিজীবী দম্পতি

হাল আমলের তরুণ-তরুণীদের অনেকে ঘর বাঁধার আগে থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন যে স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই চাকরি করতে হবে। এটা যেমন জীবিকার জন্য, তেমনি নারী-পুরুষ উভয়ের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ও নিজের মেধা মননের বিকাশের জন্যও। ফলে জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ার পাশাপাশি তাঁদের ব্যস্ততাও বেড়েছে অনেকখানি। কিন্তু এই ব্যস্ততা অনেক সময় দুজনের মধ্যে দূরত্বও তৈরি করছে। সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হলে সংসারে নানা অশান্তি দেখা দিতে থাকে। অথচ পারস্পরিক বোঝাপড়া থাকলে দূরত্ব দূর করা কঠিন কিছু নয়।

ব্যাংক কর্মকর্তা তানজিলা শায়লা (ছদ্মনাম) জানান, ‘আমরা চাকরিজীবী দম্পতি’। শায়লার স্বামী একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। দুজনই দুজনের কর্মক্ষেত্রে ভীষণভাবে ব্যস্ত থাকেন। তার পরও নিজেদের মধ্যে ভালোবাসা, সমঝোতা বজায় রাখতে উভয়েই সচেষ্ট।

শায়লা বলেন, ‘অফিস থেকে ফিরে খুব একটা বিশ্রাম নেওয়ার সময় পাই না। সংসারের নানা কাজ, সঙ্গে পরের দিন অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি আগের রাতেই সেরে রাখতে হয়। চাকরির পাশাপাশি সন্তান এবং সংসার সামলানো স্বামীর অংশগ্রহণ ছাড়া আমার একার পক্ষে কখনোই সম্ভব হতো না। রান্নাঘরেও স্বামী আমার পাশে থাকে, কাজে সাহায্য করে। এই ছোট কাজগুলো আমাকে অনেক আরাম দেয়। তাই চাকরি ও সংসার সামলাতে আমার কখনো মানসিক ক্লান্তি আসেনি।’

শায়লার পরিবারের মতো হয়তো এমন অনেক পরিবারই আছে। কিন্তু এর ব্যতিক্রমই মনে হয় বেশি। এক বছর আগে ডিভোর্স হয়েছে নাদিয়া রহমানের (ছদ্মনাম)। এক সন্তান নিয়ে ঢাকার একটি নামকরা কলেজের এই শিক্ষক এখন আলাদা থাকছেন। নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সংসারে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের ভূমিকা সমান থাকা জরুরি। কারণ সম্পর্কের মধ্যে ধারাবাহিক স্যাক্রিফাইস একসময় কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। সঙ্গে বিশ্বাসটাও প্রয়োজন। বিশেষ করে একজন অন্যজনের কাজ ও কর্মক্ষেত্রকে যদি সম্মান না করতে পারেন, তাহলে সংসার টিকিয়ে রাখা কঠিন।’

চাকরিজীবী দম্পতিদের প্রসঙ্গ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মেহজাবীন হকের সঙ্গে আলাপচারিতায় এই মনোবিজ্ঞানী বললেন, ‘বর্তমান সময়ে নারী-পুরুষ উভয়ই উচ্চশিক্ষিত হচ্ছেন। বাইরে নানা কাজে নিয়োজিত হচ্ছেন। অর্থনৈতিক মুক্তি সংসারকে যেমন আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করছে, তেমনি কিছু ছোট ছোট ভুলের জন্য স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অদৃশ্য দেয়ালও তৈরি করছে একান্ত অগোচরে। একটা সময় পর এই অদৃশ্য দেয়াল ভেঙে ফেলা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। আর তখনই দাম্পত্য জীবনে অশান্তি শুরু হয়। যার শেষ পরিণতি সংসারে ভাঙন।’

সংসার নয়, দেয়ালটা ভাঙুন

একসঙ্গে জীবনযাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই সব নয়। এর সঙ্গে সঙ্গে নারী-পুরুষ উভয়কেই নতুন জীবনে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য পুরোনো অভ্যাসগুলো থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বিয়ের আগে যা যা করা হতো, যেভাবে বাইরে বন্ধুদের সঙ্গে সময় দেয়া যেত, বিয়ের পর সবকিছু ঠিক আগের মতোই চালানোটা কঠিন। বন্ধুত্ব, আড্ডা সবই করতে হবে জীবনের এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে। নতুন জীবনকে মেনে নিয়ে চলতে হবে। আর তা শুধু চাকরিজীবী নয়, প্রত্যেক দম্পতির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এমনটাই মনে করেন মনোবিজ্ঞানী মেহজাবীন হক। তিনি বলেন ‘চাকরিজীবী দম্পতির যেহেতু পরিবারের বাইরেও আলাদা একটা জগত্ থাকে, তাই ভুল-বোঝাবুঝির সম্ভাবনাও একটু বেশি থাকে। শুরু থেকেই এ ব্যাপারে দুজনকে সচেতন হতে হবে।’

চাকরিজীবী দম্পতির মধ্যে দেয়াল তৈরি করতে পারে এমনকি সংসার ভাঙারও কারণ হয়ে উঠতে পারে এমন কিছু ছোট ছোট ভুলের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তিনি—

অফিস থেকে ফিরে স্বামী বিশ্রাম নিলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় স্ত্রী বাইরের পোশাক পরিবর্তন করার সময়টুকুও পাচ্ছেন না। তাঁকে সংসারের কাজে নেমে পড়তে হচ্ছে। ছেলেদের মধ্যে ঘর-সংসারের দায়িত্ব স্ত্রীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার একটি প্রবণতা কাজ করে। স্ত্রী বিষয়টি একদিন, দুদিন মেনে নিলেও একটা সময় বিষয়টি নিয়ে খিটিমিটি তৈরি হওয়া বিচিত্র নয়।

চাকরিজীবী দম্পতির আলাদা একটা জগত্ তাঁদের কর্মক্ষেত্র। ব্যস্ততার বেড়াজালে অনেক সময় পরিবারের চেয়ে কর্মক্ষেত্র প্রধান হয়ে ওঠে। সম্পর্কে দেয়াল তৈরি হওয়ার পেছনে এটা একটা বড় কারণ।

একে অন্যের প্রতি বিশ্বাসহীনতা, সন্দেহমূলক মনোভাব সম্পর্ক শীতল করার পাশাপাশি সম্পর্ক ভাঙার ক্ষেত্রেও দায়ী।

সম্পর্ক হোক মধুর

দিনের শুরু যেমন ঘর, শেষটাও তেমনি ঘরেই। সমস্ত দিনের শেষে ঘরে ফেরার তাগিদ থাকে না, এমন মানুষ কমই আছেন। ঘর এমনই এক আশ্রয়। এই আশ্রয়কে টিকিয়ে রাখতে হলে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সমঝোতা ও ভালোবাসা জরুরি। সমস্ত দিন নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত থাকার পাশাপাশি স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই একে অন্যের জন্য সময় বের করতে হবে। যেটুকু একান্তই দুজনের। এটুকু ভালোবাসবার অবসর। সম্পর্ককে মধুর রাখতে এটা খুবই জরুরি।

মধুর প্রেম, মধুর ভালোবাসায় অনেক স্বপ্ন নিয়ে সংসারশিল্পে প্রবেশ করা তরুণ চাকরিজীবী দম্পতিদের জন্য মনোবিজ্ঞানী মেহজাবীন হকের পরামর্শ হচ্ছে—

১. যেকোনো সম্পর্ক সুন্দরভাবে টিকিয়ে রাখতে হলে তার যত্ন নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে দুজনকেই সমান ভূমিকা রাখতে হবে। ঘরে ফেরার পর অফিসের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকা উচিত নয়। দিন শেষের এ সময়টা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কাটাতে হবে।

২. পারস্পরিক সমঝোতার জায়গাটা স্পষ্ট থাকতে হবে। সংসারের ছোট ছোট কাজ ভাগ করে নিতে হবে। যেসব কাজের দায়িত্ব স্বামী নিতে পারবেন না, সেখানেও স্ত্রীর পাশে থাকতে হবে। রান্নাঘরে, খাবার টেবিল সাজাতে স্ত্রীর পাশে থাকলে স্ত্রীর মধ্যে ভালোলাগা কাজ করে। এই ভালোলাগাটা সংসারের জন্য জরুরি।

৩. পারস্পরিক বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। একজনের কর্মক্ষেত্র ও কাজের প্রতি অন্যজনের শ্রদ্ধা থাকতে হবে। স্বামীর বন্ধুবান্ধব, সহকর্মীদের প্রতি অকারণ সন্দেহ প্রকাশ থেকে স্ত্রীকে দূরে থাকতে হবে। তেমনিভাবে স্ত্রীর বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের বিষয়েও স্বামীকেও একই আচরণ করতে হবে। কোনো কারণে মনে সন্দেহের সৃষ্টি হলে তা ভেতরে পুষে না রেখে শেয়ার করতে হবে একের সঙ্গে অন্যের।

৪. কাজের প্রয়োজনে অফিস থেকে ফিরতে মাঝেমধ্যে দেরি হতেই পারে, এ বিষয়ে দুজনকেই উদার মানসিকতার পরিচয় দিতে হবে।

৫. সংসারে মাঝে মাঝে খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে ঝগড়া হতে পারে, এ ক্ষেত্রে অনেক সময় ঝগড়া মেটাতে দুজনের মাঝে তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি দেখা যায়। এতে সম্পর্ক ঠিক হওয়ায় চেয়ে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে, তাই নিজেদেরই তা মেটাতে হবে।

৬. সময়ের সঙ্গে উদ্ভূত সব চাহিদা মিটিয়ে সন্তান ও পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে ভালো থাকার জন্যই স্বামী-স্ত্রী উভয়ই কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেন। সুন্দর জীবনযাপনের জন্য অর্থ যেমন প্রয়োজন, তেমনি পারস্পরিক সমঝোতা ও দায়িত্ববোধও জরুরি।

শেয়ার করুন