মাদক নিয়ন্ত্রণ দফতর, র্যাব, পুলিশ, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর অব্যাহত অভিযান, মোবাইল কোর্টে সাজা প্রদান, একের পর এক মামলা করেও রোধ করা যাচ্ছে না সর্বনাশা মাদকের বিস্তার। বরং দেশে একের পর এক আমদানি হচ্ছে নতুন নতুন নামের মাদকদ্রব্য। বাড়ছে সেবনকারী। বাড়ছে ব্যবসায়ী। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপে বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশে মাদকাসক্তির উদ্বেগজনক চিত্র। বাংলাদেশের মাদক ব্যবহার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের একটি জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখানে কমপক্ষে ৬৫ লাখ মানুষ সরাসরি মাদকাসক্ত। এদের মধ্যে ৮৭ ভাগ পুরুষ ও ১৩ ভাগ নারী। এক লাখেরও বেশি মানুষ নানাভাবে মাদক ব্যবসায় জড়িত। প্রভাবশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী ও শিশু-কিশোররাও জড়িত এ ব্যবসায়। বিজিবি সূত্রে জানা যায়, বিস্তীর্ণ সীমান্তের ৫১২টি স্পট মাদক আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহার করে চোরাচালানিরা। এসব স্পটে বিজিবি সদস্যদের ‘বিশেষ নজরদারি’র মধ্যেও রাত-দিন আসছে হেরোইন, আফিম, প্যাথেডিন, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক। জরিপকারী সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মাদক আমদানির জন্য প্রতিবছর পাচার হয়ে যাচ্ছে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা।
দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সংস্থাগুলোর সদস্যরা নিয়মিত মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে থাকেন। প্রায়ই আটক করা হয় বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য। গ্রেফতার করা হয় ব্যবসায়ী ও পাচারকারী। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের আওতাধীন কেবল রাজধানীর সবুজবাগ সার্কেলের সদস্যরা গত তিন মাসে অর্ধশতাধিক অভিযান চালিয়েছেন। এতে বিপুল সংখ্যক ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজা আটক করা হয়। এ সময় অস্ত্রসহ শতাধিক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি ঢাকা মহানগর পুলিশের মাদকবিরোধী অভিযানে গত দুই মাসেই ৬৩১টি মামলা হয়েছে। এতে ৬৪১ জন মাদক ব্যবসায়ীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। আসামিদের কাছ থেকে উদ্ধার মাদকদ্রব্যের মধ্যে ছিল মদ, হেরোইন, গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবা ইত্যাদি। কিন্তু এত কিছুর পরও মাদকের বিস্তার রোধ হচ্ছে না কোনোভাবেই। এদিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার মনিরুল ইসলামের দাবি, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক সাজা দেওয়ায় মাদক ব্যবসা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, মাদকদ্রব্যগুলোর মধ্যে ইয়াবা ট্যাবলেট আসে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম রুট হয়ে। অন্যদিকে সাতক্ষীরা, যশোর, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, রাজশাহী, নওগাঁ, কুড়িগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও ফেনীর সীমান্ত-পয়েন্টগুলো দিয়ে আসে ফেনসিডিলের চালান।
৩২ ধরনের মাদকে দেশ সয়লাব : দেশে বর্তমানে ৩২ ধরনের মাদক সেবন চলছে। এ পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন নামের যেসব মাদক উদ্ধার হয়েছে সেগুলো হচ্ছে হেরোইন, গাঁজা, চোলাই মদ, দেশি মদ, বিদেশি মদ, বিয়ার, রেক্টিফায়েড স্পিরিট, কেডিন, ফেনসিডিল, তাড়ি, প্যাথেডিন, ব্রুপ্রেনরফিন, টিডি জেসিক, ভাঙ্, কোডিন ট্যাবলেট, ফারমেনটেড, ওয়াশ (জাওয়া), বনোজেসিক ইনজেকশন (ব্রুপ্রেনরফিন), টেরাহাইড্রোবানাবিল, এঙ্এলমুগের, মরফিন, ইয়াবা, আইসপিল, ভায়াগ্রা, সেনাগ্রা, টলুইন, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, মিথাইল, ইথানল ও কিটোন। এ ছাড়া ইনোকটিন, সিডাঙ্নিসহ বিভিন্ন ঘুমের ট্যাবলেট, জামবাকসহ ব্যথানাশক ওষুধ গ্রহণ করে কিংবা টিকটিকির লেজ পুড়িয়ে কেউ কেউ নেশা করে থাকে।
মাদক-সংক্রান্ত মামলার চিত্র : সারা দেশে প্রায় ৪২ হাজার মাদক-সংক্রান্ত মামলা ঝুলে আছে। র্যাব ও পুলিশের তদন্তাধীন মামলার সংখ্যা ৩১ হাজারের বেশি। এর মধ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তদন্তাধীন মামলা রয়েছে প্রায় ১১ হাজার। অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশনস) জানান, মাদকদ্রব্য উদ্ধার ও ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে অহরহ। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই তারা আইনের ফাঁক গলে জামিনে বেরিয়ে ফের মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে আটক করা মাদকের বেশির ভাগই ভেজাল মিশ্রিত হিসেবে পাওয়া যায়। এ কারণে অভিযুক্তদের সাজা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে।’
গজিয়ে উঠেছে ১২০০ নিরাময় কেন্দ্র : মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের নামে রাজধানীসহ সারা দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে নানা প্রতিষ্ঠান। অনেক ক্ষেত্রে টাকা দিয়ে প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে চলছে এর কার্যক্রম। বেসরকারিভাবে মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র করতে হলে নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অনুমোদন প্রয়োজন। কিন্তু এগুলো চলছে কোনো রকম অনুমোদন ছাড়া। আবার কেন্দ্রগুলোতে নিরাময়ের নামে উল্টো মাদক ব্যবসা চলছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ, জেলখানার মতো ছোট ছোট কক্ষে মাদকাসক্তদের তালাবন্দী রেখে চলছে তথাকথিত নিরাময় কেন্দ্রের চিকিৎসা।
মাদকাসক্তি নিরাময়ে সরকারি ব্যবস্থা : সরকারিভাবে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পাশেই রয়েছে কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র। এ ছাড়া রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা ও বরিশালে আরও চারটি আঞ্চলিক নিরাময় কেন্দ্র আছে। ২০০৫ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘মাদকাসক্ত পুনর্বাসন প্রকল্প’ নামে প্রশংসিত একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ প্রকল্পের আওতায় ২০০৭ সালে প্রায় সোয়া ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি পাঁচ তলা ভবন নির্মিত হয়েছে, কেনা হয়েছে লাখ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র। শুধু লোকবলের অভাবে প্রকল্পটি চালু করা যাচ্ছে না।
নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বেহাল : রাজধানীতে পাইকারি ও খুচরা দরে বিক্রেতা মিলিয়ে পাঁচ শতাধিক মাদক স্পট নিয়ন্ত্রণ করছে সহস্রাধিক চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। এ ছাড়া রয়েছে অসংখ্য ভাসমান বিক্রেতা। বিশাল এ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে অধিদফতরের ঢাকা মহানগর অঞ্চলে কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন মাত্র ৫৯ জন। অভিযান পরিচালনার জন্য তাদের যানবাহন রয়েছে মাত্র তিনটি। অধিদফতরের ঢাকা মহানগর অঞ্চলের উপপরিচালক মো. রবিউল ইসলাম বলেন, জনবল ও যানবাহনসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে অভিযান চালাতে হিমশিম খেতে হয়।