মানবাধিকার পরিস্থিতি দুঃসহ

0
795
Print Friendly, PDF & Email

মানুষ অপহৃত হচ্ছে। লাশ ভেসে উঠছে নদীতে। মানুষের লাশ পাওয়া যাচ্ছে এক জায়গায়, অন্যত্র মিলছে তার ব্যবহৃত গাড়ি। অপহরণ, গুম, হত্যার ঘটনার সংখ্যা যাই হোক না কেন—এ সবই মানবাধিকারের জন্য দুঃসহ এক অবস্থা সৃষ্টি করেছে।

গত বছরের অক্টোবর থেকে নির্বাচন পর্যন্ত রাজনৈতিক হানাহানির কারণে অনেক প্রাণ গেছে। সেটি ছিল একটি ভিন্ন পরিস্থিতি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের পরিস্থিতি একেবারে আলাদা। ঢালাওভাবে বলার অবকাশ নেই যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়েই এসব ঘটনা ঘটছে। কেননা, সুনির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মীরাই কিন্তু অপহরণ বা গুমের শিকার হচ্ছেন না। এর একটি বৃহৎ পরিসর আছে। মনে হচ্ছে, অনেকেই প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে হিসাব-নিকাশ করেই এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। অপরাধী চক্র এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্নীতিগ্রস্ত চক্রকে ব্যবহার করতে পারে। এই ধারণা অমূলক নয়, অর্থের বিনিময়ে এসব ঘটনা ঘটছে। সমস্ত ঘটনায় মানুষের মনে এক নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে।

প্রতিটি ঘটনাতেই সন্দেহের তির ছোড়া হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর। এসব হত্যা ও গুমের দায় কোনোভাবেই এসব বাহিনী অস্বীকার করতে পারে না। কেননা, নাগরিকের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে এর দায় তাকে নিতেই হবে। আর অভিযোগ যখন এসব বাহিনীর বিরুদ্ধে, তখন সেই অভিযোগ খণ্ডন করার দায়ও তার। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে যখন সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠছিল, তখন থেকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি বারবার আকর্ষণ করা হলেও তা নির্মূলে খুব বড় কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সরকারের বিবেচনায় ঘাটতি আছে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

গত পরশু প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ প্রশাসনে রদবদল করার যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেটা আশাব্যঞ্জক। কিন্তু সেই শাস্তি যথেষ্ট নয়। যাঁরা অপহূত হয়েছেন, তাঁদের ফিরিয়ে আনা, পরিবারের মনে নিরাপত্তাবোধ তৈরি করাই মূল কাজ। সবচেয়ে বড় কাজ হলো, এ ধরনের একটি অপরাধের ঘটনা যাতে না ঘটে, সেই পরিবেশ তৈরি করা। আর দরকার অপরাধীদের শনাক্ত করা, উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া।

মানবাধিকারের এই পরিস্থিতিতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে। প্রথম কথাটি হলো, এটি এমন একটি সংস্থা, যার কোনো নির্বাহী ক্ষমতা নেই। আমি কোনো সাফাই গাইতে চাইছি না। বাস্তবতা হলো, প্রতিটি ঘটনার জন্য প্রতিবাদ করছি, সুপারিশ করেছি, সমালোচনা করছি। এমনকি প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথা বলছি। গতকালও নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যরা আমার কাছে এসেছিল। আমি র‌্যাবের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা আমাকে আশ্বস্ত করেছেন।

চলমান পরিস্থিতিতে আমি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলেছি। একটি আধা সরকারি পত্রে কয়েকটি সুপারিশ করেছি। একটি হলো, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারার ক্ষেত্রে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ কোনো নাগরিককে উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতেরও সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। দ্বিতীয়ত, শুধু ইউনিফর্ম পরা সদস্যই কাউকে আটক করতে পারবেন। তাঁর পরিচয়পত্র থাকতে হবে এবং আটক ব্যক্তির পরিবারকে আটকের কারণ পরিষ্কার করতে হবে। তাঁকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তা জানাতে হবে। তৃতীয়ত, কোনো নাগরিককে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন যদি হয়ই, তবে যাকে আটক করা হবে, তার পরিবারের পাশাপাশি প্রতিবেশীদের মধ্য থেকে অন্তত দুজনকে সাক্ষী রাখতে হবে।

এ কাজটি করতে গেলে সরকারের একটি পয়সাও খরচ হবে না। কেবল একটি প্রজ্ঞাপনই এর জন্য যথেষ্ট। আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, অপহরণ বা গুমের মতো ঘটনার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্পৃক্ততা শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। l
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান।

শেয়ার করুন