বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫ হাজার নারী নির্যাতিত হয়। ২০১৩ সালে পুরো বছর ধরে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজার ৭৭৭টি। এটাই মোটামুটি স্থিতিশীল অবস্থা। এর আগে ২০১২ তে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল ৫ হাজার ৬১৬টি, ২০১১ তে সর্বাধিক ৬ হাজার ৬১৬টি, ২০১০-এ ৫ হাজার ৫৭০টি। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের করা গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য ওঠে এসেছে। গবেষণাটি করা হয়েছে মূলত পত্রিকা স্টাডি থেকে। তারা ১৪টি প্রথম শ্রেণীর জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রকাশিত খবর থেকে এই তথ্যগুলো সংগ্রহ করে। প্রতি মাসে তারা যে তথ্যগুলো সংগ্রহ করে, তার যোগফল এই পরিসংখ্যানগুলো।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ছাড়াই ২০১১ সালে নারীর উপর শুধুমাত্র যৌন হয়রানি, নিপীড়ন ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে মোট ১ হাজার ১২৮টি। ঘটনাগুলোর মধ্যে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২৩৯জন এবং প্রাপ্ত বয়স্ক নারী ছিল ৫৮৯ জন। ১৮ বছরের কম বয়সীদের এখানে শিশু বলা হয়েছে। নির্যাতনের শিকার নারীর পেশা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ছাত্রীরা বেশী নির্যাতনের শিকার। এদের সংখ্যা ৩৬ পার্সেন্ট, ৩৩ ভাগ গৃহিণী নির্যাতনের শিকার।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম বললেন, নারী নির্যাতন উত্তরোত্তর বাড়ছে। পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ, যা নারী নির্যাতনের সংস্কৃতিকে সমর্থন করে , তা প্রতিরোধ ও নিরোধের লক্ষ্যে, জাতীয় নীতি ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। তা না হলে এ অবস্থার উন্নতি আশা করা যায় না।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বললেন, নারী নিজে সচেতন হলে অনেক সমস্যার সমাধান সহজ হয়ে যায়। বাসায় কোনো কাজের মেয়ে রাখলে, তার নিরাপত্তার দিকে গৃহিণীর সচেতন দৃষ্টি রাখতে হবে। তেমনি, কন্যাশিশুকে স্কুলে আনা নেয়ার কাজ মা অথবা বাবা কিংবা কাজের বুয়াকে দিয়ে করানো যেতে পারে। অন্য কোন পুরুষ আত্মীয়কে দিয়ে নয়। মামা চাচার মতো আত্মীয়দের দিয়েও শিশুরা অনেক সময় সেক্সুয়াল হেরাজম্যান্টের শিকার হয়। যা পরিবারে বলতে পারে না। পরিবার জানলেও অনেক ক্ষেত্রেই মান-সম্মানের কথা ভেবে কোনো একশনে যায় না। এলিনা খান বলেন, কর্মজীবী নারীরা নির্যাতনের মুখোমুখি হলে তাদের প্রতিবাদী ভূমিকা নিতে হবে। সাহস করে প্রতিবাদী হলে, একদিন সে নিজেই তার কর্মপরিবেশকে অনুকূল দেখতে পাবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের, ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরি টেকনিক্যাল এডভাইজার ড. শরীফ আখতারুজ্জামান বলেন, রেপ কেসের ক্ষেত্রে মাত্র ১০ পার্সেন্ট আমরা বিচারাধীন মামলাগুলোতে দিতে সক্ষম হই। কারণ ভিকটিমের ডিএনএ টেস্টের সাথে যার মাধ্যমে ভিকটিম নির্যাতিত হচ্ছে, তার ডিএনএ টেস্ট করা না গেলে এইসব পরীক্ষার রেজাল্ট কোনো কাজে দেয় না। তাই এক্ষেত্রে যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের এই বিষয়টি মাথায় রাখা দরকার। নির্যাতনকারীদের শনাক্ত করে তাদের ডিএনএ টেস্টের ব্যবস্থা রাখা উচিত। এভাবে অনেক ভিকটিমকে ন্যায় বিচার দেয়া সম্ভব।
বাংলদেশের, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তুরিন আফরোজ বললেন, নারী নির্যাতন যারা করে, তারা এক ধরনের অসুস্থ মানসিকতার লোক। উন্নত দেশগুলোর মতো আমাদের দেশেও নির্যাতনকারীদের জন্য কাউন্সিলিং সেন্টার থাকা দরকার। যাতে কাউন্সিলিং করে তাদের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন ঘটানো যায়।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার বললেন, শারীরিক নির্যাতন তো দেখা যায়। কিন্তু মানসিক নির্যাতনের প্রভাব ভয়ানক ক্যান্সারের মতো। এটা প্রত্যক্ষ করা যায় না বা এর বিচার চাওয়ারও সুযোগ নেই। কন্যাশিশুদের প্রতি ছোট থেকেই যে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়, তাতে তাদের আত্মমর্যাবোধ, আত্মবিশ্বাস অনেকটাই কমে যায়। পরবর্তী জীবনে এটা ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। মেখলা সরকার বলেন, ছেলে শিশুদের ব্যাপারটাও এরকম। ছোটবেলা থেকেই যদি বোনের প্রতি শেয়ারিংয়ের মনোভাব, নিজের মা, বোনের মতো করে অন্য নারীর প্রতি সম্মানবোধের অভ্যাস গড়ে তোলা যায়, তাহলে সে আর কোনো নারীর প্রতি নির্যাতনের মানসিকতা নিয়ে গড়ে ওঠবে না। এভাবে ছেলেদের ছোটবেলা থেকেই গড়ে তুলতে পারলে সামাজিক অবস্থা অনেকাংশেই পাল্টে যাবে আশা করা যায়।