দ্রম্নত বেড়েছে কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা :: দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পশ্চিমা বিশ্ব সবদলের অংশগ্রহণে মধ্যবর্তী নির্বাচনের আওয়াজ তুললেও এখন চুপচাপ :: আনত্মর্জাতিক মহলের সুদৃষ্টি ফেরাতে সরকারের কূটনীতি সফল
আঙ্গুর নাহার মন্টি : বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর বর্জনের মধ্য দিয়ে গত ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে টানা দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে৷ তত্কালীন বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জনের কারণে জাতিসংঘ ও পশ্চিমা বিশ্বের গভীর হতাশা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্রসহ গুরম্নত্বপূর্ণ দেশগুলোর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেৰণে না আসা এবং মাত্রাতিরিক্ত রাজনৈতিক সহিংসতা বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণসহ বিভিন্ন কারণে জাতীয় ও আনত্মর্জাতিকভাবে আরেকটি ওয়ান-ইলেভেনেরও আশঙ্কা করা হয়েছিল৷ ভারত ছাড়া কোনো বিদেশী বন্ধু সরকারকে (বিএনপি ছাড়া সংবিধান সম্মত) ওই নির্বাচনে সমর্থনও দেয়নি৷ এমনকি নির্বাচনের পরও পশ্চিমা বিশ্ব সবদলের অংশগ্রহণে মধ্যবর্তী নির্বাচনের আওয়াজ তুলেছিল৷ বর্তমান সরকারের ১০০ দিন পর দেখা যাচ্ছে, আরেকটি নির্বাচনের চেয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আনত্মর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্বিপাৰিক ও বহুপাৰিক সম্পৃক্ততা বাড়াতেই আগ্রহ বেশি৷ বিশেষ করে সবদলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের জন্য অব্যাহতভাবে তাগিদ দিতে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বর্তমান সরকারের কূটনৈতিক যোগাযোগ ও সম্পৃক্ততা বেড়েছে সবচেয়ে বেশি৷ এরই ফলশ্রম্নতিতে সম্প্রতি ঢাকায় হয়ে গেলো ঢাকা-ওয়াশিংটন নিরাপত্তা সংলাপ৷ আগামী ২৮ এপ্রিল রাজধানীতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে টিকফার প্রথম কাউন্সিল৷
নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ইইউসহ বিভিন্ন দেশের ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতরা ওই নির্বাচনে ‘জনমতের পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন ঘটেনি’ বলে মনত্মব্য করেছেন৷ তারা অর্ধেকেরও বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়াতে এই নির্বাচনকে ত্রম্নটিপূর্ণও বলেন৷ প্রভাবশালী উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোর সরকারের পৰ থেকে একই বার্তাসহ বিবৃতি আসার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী ও নতুন সরকারকে অভিনন্দনও জানানো হয়েছে৷
তৃতীয়বার দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার পর গঠিত মন্ত্রিসভায় শেখ হাসিনা প্রথমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে পূর্ণ মন্ত্রী নিয়োগ করেননি৷ ওই সময় তিনি অপেৰাকৃত তরম্নণ নেতা শাহরিয়ার আলমকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ করেন৷ আর নতুন সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী দায়িত্ব নিয়েই আনত্মর্জাতিক মহলের সুদৃষ্টি ফেরাতে কাজ শুরম্ন করেন৷ ঢাকায় নিযুক্ত কূটনীতিকদের নিজ কার্যালয়ে আমন্ত্রণ করে এনে প্রধানমন্ত্রীর শপথ গ্রহণের পরপরই সংবাদ সম্মেলনে দেয়া বক্তব্যের সঙ্গে সুর মিলিয়ে জানান, সংবিধান সম্মত এই নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা, প্রয়োজনীয়তা ও সরকারের অবস্থান৷ আর বিপুল অর্থব্যয়ে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে বলেও তিনি কূটনীতিকদের কাছে অভিমত ব্যক্ত করেন৷ শুধু তা-ই নয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পৰ থেকে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতেও একই বার্তা পেঁৗছে দেয়া হয়৷ যাতে বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূতরা সংশিস্নষ্ট দেশগুলোতে সরকারের অবস্থান জানাতে পারেন৷
এদিকে বিএনপির কোনো আন্দোলন সফল না হওয়া, হরতাল-ধর্মঘটের মতো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অল্পদিনেই সামাল দিতে সৰম হয় সরকার৷ ফলে বাংলাদেশে বাণিজ্য ও বিনিয়োগে আগ্রহী আনত্মর্জাতিক সম্প্রদায় সরকারের পথেই হাঁটতে শুরম্ন করে৷ বিদেশী স্বীকৃতির ঝুঁকিটা অনায়াসে উতরে যায় সরকার৷ এরইমধ্যে গত
২৫ ফেব্রম্নয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান সাবেক কূটনীতিক আবুল হাসান মাহমুদ আলী৷ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পূর্ণ মন্ত্রী আসার পর রম্নটিন কাজও আরো গতিশীল হয়৷ পররাষ্ট্র মন্ত্রীও পুরোদমে কূটনৈতিক যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন৷ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপাৰিক ও বহুপাৰিক যোগাযোগ ও কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ সরকারের একশ দিন পেরিয়ে এখন সরকারের সঙ্গেই হাঁটছে আনত্মর্জাতিক সম্প্রদায়৷
এদিকে বর্তমান সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফুশিও কিশিদা বাংলাদেশ সফর করে গেছেন৷ আট বছর পর জাপানের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এটিই ছিল প্রথম বাংলাদেশ সফর৷ এ সফরে জাপান তার সরকারি উন্নয়ন সহযোগিতার (ওডিএ) আওতায় বাংলাদেশের পাঁচটি প্রকল্পে ১১৮ কোটি ডলার (১২০ বিলিয়ন ইয়েন) দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে৷ এ মাসেই ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রী অ্যালান ডানকান ঢাকা সফর করেন৷ তিনি সাংবাদিকদের বলে যান, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অস্বাভাবিক হলেও বৈধ৷ আর তার সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করবে৷ আর ভারত, চীন, রাশিয়া বরাবরই সরকারের পাশে ছিল৷ এছাড়া মার্চে বেসরকারি সফর করেন আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার ও সেদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির বিন মোহাম্মদ৷ ওই মাসেই নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জিম বলগার ও চীনের গুরম্নত্বপূর্ণ প্রদেশ ইউনানের গভর্নর লি জি হিং বাংলাদেশ ঘুরে যান৷ এ মাসেই ঢাকা সফর করেন দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) মহাসচিব অর্জুন বি থাপা এবং উজবেকিসত্মানের বৈদেশিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক, বাণিজ্য ও বিনিয়োগমন্ত্রী ইলিওর গানিয়েভ৷ এসব সফর ও কূটনৈতিক ব্যবস্থা স্বাভাবিকভাবেই সরকারেও স্বসত্মি বয়ে আনে৷ আজ শনিবার ঢাকায় আসছেন সাত সদস্যের জার্মানির সংসদীয় প্রতিনিধিদল৷ রানা পস্নাজা ট্র্যাজেডির পর এ দেশের তৈরি পোশাকশিল্প পরিস্থিতি অগ্রগতি দেখার পাশাপাশি তারা অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপরও গুরম্নত্ব দেবেন৷
এদিকে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল তার সরকারের পৰ থেকে স্থিতিশীল গণতন্ত্রের জন্য সবদলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের তাগিদ অব্যাহত রাখলেও ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডবিস্নউ মজিনা এখন তার বক্তব্যে আরেকটি নির্বাচন নিয়ে তেমন কিছুই বলছেন না৷ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন বিষয়ে আগের অবস্থানেই আছে বললেও তিনি দ্বিপাৰিক সম্পর্ক জোরদারের ওপরই বেশি গুরম্নত্ব দিচ্ছেন৷ বারবার বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের বিশেষ গুরম্নত্বের কথা৷
যুক্তরাষ্ট্র সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা অর্জনের জন্য বাংলাদেশের প্রশংসাও করছে৷ আর বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার স্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে উন্নয়নমূলক কর্মসূচি বাসত্মবায়ন করা হচ্ছে৷ সম্প্রতি বাংলাদেশের নাগরিক সমাজকে শক্তিশালীকরণ ও তারম্নণ্যের ক্ষমতায়নের দুটি প্রকল্পে ৬ লাখ ডলার বা ৪ কোটি ৬৫ লাখ ২০ হাজার টাকা সহযোগিতা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বু্যরো অব ডেমোক্রেসি ও হিউম্যান রাইটস এন্ড লেবার (ডিআরএল) সংস্থা৷ নির্বাচন ইসু্যতে যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে বেশি সরব থাকলেও নতুন করে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর গত কয়েক মাসে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যসত্মতা ছিল ওয়াশিংটনকেন্দ্রিক৷ গত সপ্তাহে (২২ এপ্রিল) ঢাকায় দুদেশের বার্ষিক নিরাপত্তা সহযোগিতা সংলাপ হয়েছে৷ দুদেশের নিরাপত্তা ও সামরিক সহযোগিতা আরো জোরদারে একমত হয়েছে৷ বাংলাদেশ সমুদ্র নিরাপত্তায়ও সহায়তা চেয়েছে মার্কিন সরকারের৷
এদিকে এ সপ্তাহে অর্থাত্ আগামী সোমবার (২৮ এপ্রিল) টিকফার প্রথম কাউন্সিলও ঢাকায় হতে যাচ্ছে৷ এই নিয়ে ব্যসত্ম দুদেশের কূটনৈতিক চ্যানেল৷
একদিকে আনত্মর্জাতিক সম্প্রদায়কে কাছে টানতে কূটনৈতিক যোগাযোগ ও সম্পৃক্ততা বাড়াচ্ছে সরকার৷ অন্যদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বিদেশের মিশনগুলোর কার্যক্রমে গতি আনতে পুনর্বিন্যাসের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷ গুরম্নত্বপূর্ণ মিশন ও পদে চলছে পদায়ন ও রদবদল৷ যেন ঢেলে সাজানো হচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মিশনগুলো৷
গত সাড়ে তিন মাসে সরকারের এই কূটনৈতিক অগ্রগতির প্রশংসা করে বর্ষীয়ান কূটনীতিক ওয়ালি উর রহমান বলেন, বিশ্ব বুঝে গেছে বর্তমান সরকার শানত্মি, গণতন্ত্র ও সমৃদ্ধির পৰে কাজ করছে৷ মানবাধিকার রৰাসহ দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও অন্য সময়ের চেয়ে ভালো রাখতে পারছে৷ বন্ধুরাষ্ট্র ও উন্নয়ন সহযোগীরা উন্নয়ন ও বিশ্বায়নের যুগে এগুলোই চায়৷ আর বিএনপির ভাঁওতাবাজিও সারা দুনিয়া বিশেষ করে পশ্চিমারা বুঝে গেছে৷ ওরা জেনে গেছে, বিএনপি চেয়েছিল কোনো কাজ না করে বিদেশীদের মাধ্যমে ৰমতায় যেতে৷
একশ দিনের হিসেবে ঠিক ট্র্যাকে থাকা সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জও রয়েছে উলেস্নখ করে সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ, জিএসপি বহাল, রোহিঙ্গা সমস্যা, তিসত্মার পানিবন্টন চুক্তিসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ সরকারের রয়েছে৷ তবে সঠিকভাবে হোমওয়ার্ক করে, আনত্মরিক উদ্যোগ নিলে এবং সংশিস্নষ্ট বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়ে জনগণকে দেয়া সব প্রতিশ্রম্নতি সরকার দ্রম্নত বাসত্মবায়নে সফল হবে বলে আমি বিশ্বাস করি৷