বিনিয়োগ স্থবির

0
175
Print Friendly, PDF & Email

আগে শিল্পকারখানায় গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ সহসাই পাওয়া যেতো। কিন্তু এখন গ্যাস, বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য মধ্যস্বত্বভোগীদের পেছনে ঘুরতে হয়। তাদের পেছনে ব্যয় করতে হয় বিপুল অর্থ। শিল্পের অন্যতম এ দুটি উপাদানের সংযোগ পেতে এখন প্রতি পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের। এর বাইরে আরো বাস্তবতা তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে উদ্যোক্তারা শিল্পমুখী হচ্ছেন না। এতে প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে সামাজিক অস্থিরতা প্রকট আকার ধারণ করবে।
গতকাল কথাগুলো বলেন দেশের প্রতিষ্ঠিত একজন শিল্প উদ্যোক্তা। এ উদ্যোক্তার মতো হাজারো উদ্যোক্তার একই সমস্যা। তারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিল্পকারখানায় গ্যাস, বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে চান। নতুন নতুন শিল্পকারখানার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে চান। কিন্তু তারা তা পারছেন না।
বিনিয়োগ বোর্ডের পরিসংখ্যান মতে, মাত্র এক মাসের ব্যবধানে জানুয়ারির চেয়ে বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে প্রায় ৮২ শতাংশ, আর কর্মসংস্থান কমেছে ৮৭ শতাংশ। গত জানুয়ারিতে বিদেশী ও যৌথ বিনিয়োগ হয়েছিল ৮১৬ কোটি টাকার। ফেব্রুয়ারিতে এসে তা কমে নেমেছে দেড় শ’ কোটিতে। এ কারণে নতুন কর্মসংস্থানও কমে গেছে। জানুয়ারিতে বিদেশী ও যৌথ বিনিয়োগ থেকে কর্মসংস্থান হয়েছিল পাঁচ হাজার ৫৫৮ জনের। ফেব্রুয়ারিতে তা নেমেছে ৭৩২ জনে। শুধু বিদেশী ও যৌথ বিনিয়োগ নয়, স্থানীয় বিনিয়োগেও ভাটা পড়েছে। জানুয়ারিতে স্থানীয় বিনিয়োগ হয়েছিল চার হাজার ৩০৩ কোটি টাকার। ফেব্রুয়ারিতে তা নেমেছে দুই হাজার ৬০৩ কোটিতে।
বর্তমান সরকারের গত মেয়াদের বেশির ভাগ সময়েই সঙ্কটের কারণে শিল্পকারখানায় গ্যাসসংযোগ বন্ধ ছিল। আর তার সাথে ছিল বিদ্যুৎসঙ্কট। এর ফলে বিনিয়োগে ভাটা ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, গার্মেন্টে আগুন, ভবন ধস সব মিলিয়ে বিনিয়োগের চাকা বর্তমানে একেবারেই স্থবির হয়ে পড়েছে। গত সাড়ে চার বছরের মধ্যে বিনিয়োগ সর্বনি¤œ পর্যায়ে নেমে এসেছে।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ অবকাঠামো সুবিধার অভাবের পাশাপাশি চলমান পরিস্থিতিতে আস্থার সঙ্কটে ভুগছেন ব্যবসায়ীরা। সব ধরনের বিনিয়োগ থেকে কার্যত তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। আর পুরনো শিল্পকারখানা টিকিয়ে রাখাই দায় হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে নতুন বিনিয়োগের ব্যাপারে তারা ভাবতেও পারছেন না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের রফতানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি) সভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, গ্যাস, বিদ্যুৎসঙ্কটের পাশাপাশি নানা প্রতিবন্ধকতায় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা এবং তাদের উৎপাদিত পণ্য। তার মতে, দেশে শিল্পের প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য নতুন শিল্পকারখানা স্থাপনের বিকল্প নেই। কিন্তু এসব শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য সরকার অবকাঠামো সুবিধা দিতে পারছে না। দীর্ঘ দিন ধরেই এ অবস্থা চলছে। তারা বিদ্যমান শিল্পকারখানায়ই গ্যাস-বিদ্যুতের ঠিকমতো সরবরাহ করতে পারছে না। এর পাশাপাশি ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদ তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে ব্যবসায়ীদের এখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এ পরিস্থিতিতে তাদের বিদ্যমান শিল্পকারখানাই চালু রাখা দায় হয়ে পড়েছে। ব্যবসাবাণিজ্যের অচলাবস্থার জন্য ব্যাংকঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না অনেকেই। নতুন করে ঋণখেলাপির খাতায় নাম লেখাচ্ছেন অনেকেই।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, দীর্ঘ দিন ধরে ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগশূন্যতা চলছে। চলমান পরিস্থিতির কারণে বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকের দিকে আসছেন না। নতুন কোনো শিল্পকারখানায় বিনিয়োগ নেই। বিনিয়োগ মন্দার প্রভাবে আমানতের সুদের হার কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু পরিচালন ব্যয় না কমায় সুদের হারে তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারছেন না। আবার বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে চলছে। এ দিকে ব্যবসাবাণিজ্যের মন্দার কারণে ব্যবসায়ীরা ব্যাংকঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। এতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। আর খেলাপি ঋণের পরিমান বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে। এতে ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা কমে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশির ভাগ ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা গত বছরের চেয়ে কমে গেছে। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে সামনে ব্যাংকিং খাতের জন্য অশনি সঙ্কেত অপেক্ষা করছে বলে তারা মনে করছেন।
ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের মতে, দেশে চলমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগমুখী করতে অবকাঠামো সুবিধা বাড়াতে হবে। বিদ্যুৎ, গ্যাসসংযোগের নীতিমালা সহজ করতে হবে। দুর্ভোগ কমাতে হবে উদ্যোক্তাদের। একজন উদ্যোক্তা বলেন, শুধু শিল্পকারখানায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসসংযোগের নীতিমালা সহজ করা হলে অনেকেই বিনিয়োগমুখী হবে। এতে বাড়বে কর্মসংস্থান, যা জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

শেয়ার করুন