এখনো বিকট শব্দ শোনেন, স্মৃতিতে শাহিন

0
289
Print Friendly, PDF & Email

মিনু আক্তার প্রায় এক বছর ধরে রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না। সব সময় তিনি বিকট শব্দ শুনতে পান। ছাদ-ধসের ভয়ে হঠাত্ জেগে ওঠেন তিনি। ভবনের সিঁড়িতে উঠতে পারেন না, যদি ধসে পড়ে!
রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় বেঁচে যান ২৩ বছর বয়সী এই নারী। কিন্তু ওই ঘটনার ক্ষত তাঁর মনে আজও তাজা। ক্ষণে ক্ষণে সেই দুঃসহ স্মৃতি তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়। মনে পড়ে ওই দুর্ঘটনায় নিহত প্রিয় মানুষটির মুখ। তখন তাঁর গাল বেয়ে কান্নার জল নামে।
রানা প্লাজা ধসের প্রায় এক বছর হতে চলছে। নয় তলার ওই ভবনটিতে অবস্থিত পোশাকের একটি কারখানায় কাজ করতেন মিনু। প্রতিদিনের মতো ২৪ এপ্রিল সকালে কাজে যোগ দেন তিনি। ট্রাউজার বানানোর জন্য কাপড় কাটছিলেন। তাঁর প্রিয় মানুষ শাহিনও একই কারখানায় কাজ করতেন। পাঁচ বছরের সম্পর্ক তাঁদের। দুজনই হাসিমুখে কাজ শুরু করেছিলেন সেদিন। হঠাত্ বিকট শব্দ। ধোঁয়ায় চারদিক আচ্ছন্ন। আশ্রয়ের খোঁজে সবাই দৌড়াতে থাকেন। মিনুর চোখ তখন শাহিনের দিকে। শাহিন অপেক্ষা করছেন মিনুর জন্য—একসঙ্গে দুজন নিরাপদে বেরিয়ে যাবেন।

এর প্রায় দুই সপ্তাহ পর হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মিনু জানতে পারেন, শাহিন আর নেই। ধ্বংসাবশেষ থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।

রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩৮ জন নিহত হয়েছেন। শাহিন তাঁদেরই একজন। ওই ঘটনায় আহত হন দুই সহস্রাধিক।

স্মৃতি থেকে মিনু বলতে থাকেন, ‘আমি কয়েকদিন বিশ্বাসই করতে পারিনি যে, ও মারা গেছে। আমাদের কত স্বপ্ন ছিল। বিয়ে করতে কাজি অফিসেও গিয়েছিলাম আমরা। তবে শেষ পর্যন্ত পরিবারের সম্মতির জন্য অপেক্ষার সিদ্ধান্ত নিই।’

শাহিন-মিনুর ঘর বাঁধার স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেছে।

ভয়াবহ সেই বিপর্যয়ের পর প্রায় এক বছর কেটে গেছে। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে কিছু পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর মনে সেই ক্ষত এখনো তাজা।

মনের ক্ষত সারাতে মিনু আক্তার এখন কাউন্সিলিং নিচ্ছেন। এ রকম আরও অনেকেই বিশেষজ্ঞদের অধীনে পরামর্শসেবা নিচ্ছেন। বিশেষজ্ঞ ওবায়দুল ইসলাম জানান, এখন পর্যন্ত চারটি দলকে এমন সেবা দেওয়া হয়েছে। রোগীদের প্রায় সবাই মনস্তাত্ত্বিক আঘাতে ভুগছেন। বেশির ভাগই রাতে ঘুমাতে পারেন না। তাঁরা সামান্য শব্দও সহ্য করতে পারেন না। অনেকে স্মৃতি হারিয়েছেন। তাঁরা শরীরের গন্ধ পান। পাশেই মৃত শ্রমিকদের লাশ দেখতে পান। এমনকি কেউ কেউ বহুতল ভবনে ঢুকতে পারেন না।

রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের পোশাক কারখানার পরিবেশ উন্নয়নের দিকটি জোরালোভাবে সামনে চলে আসে। শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়িয়েছে সরকার। ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের আইন সহজ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে দুর্ঘটনা রোধে কারখানা পরিদর্শনে তত্পরতা বেড়েছে। এ কাজে প্রায় ২০০ জন পরিদর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের নেতারা বলছেন, আন্তর্জাতিক শ্রমিক অধিকার সংগঠন, গণমাধ্যম ও পশ্চিমা ক্রেতাদের চাপে কারখানার পরিবেশের কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। তবে এই খাতের উন্নয়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এখনো অনেক কিছু করার রয়েছে। শ্রমিকেরা এখনো বিশ্বের সবচেয়ে কম মজুরি পান। দিনে তাঁরা ১০-১২ ঘণ্টা শ্রম দেন।

সরকার ও বিদেশিদের পক্ষ থেকে রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ওই দুর্ঘটনায় যে ক্ষতি তাঁদের হয়ে গেছে, তা অবর্ণনীয়। অনেকে আর কোনো দিন কাজে ফিরতে পারবেন না। ওই দুর্বিষহ বেদনার স্মৃতির সঙ্গে বাস করছেন অনেকেই।

শেয়ার করুন