বৈশাখের ভয়াবহ তাপদাহের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। রাজধানী, শহর বা গ্রাম কোথাও রেহাই নেই লোডশেডিং যন্ত্রণা। গতকাল দফায় দফায় লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে গ্রামসহ রাজধানীবাসীকে। দফায় দফায় বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে মানুষ। গ্রামে দিনের প্রায় অর্ধেক সময় বিদ্যুৎ না থাকায় শিল্পকারখানায় উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। অফিস-আদালতের কার্যক্রমের স্থবিরতা নেমে এসেছে।
তাপমাত্রার পাশাপাশি যখন পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা, তখন সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বলা হচ্ছে ভিন্ন কথা। তারা দাবি করেছেন, গতকাল কোনো লোডশেডিং ছিল না। চাহিদার সমপরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে। তবে রাজধানীসহ সারা দেশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন থাকার কারণ সম্পর্কে তারা বলেছেন, তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের লোড বেড়ে গেছে। এ কারণে বর্তমান বিদ্যুৎ বিতরণের যে সিস্টেম রয়েছে তা দিয়ে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি তাপমাত্রার কারণে ট্রান্সফরমার ও বিদ্যুতের সাবস্টেশন গরম হয়ে ভেতরে কয়েল পুড়ে যাচ্ছে। লোড কমানোর জন্য মাঝে মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।
পিডিবির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা যতই বাড়িয়ে দেখানো হোক না কেন চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা মোটেও সম্ভব নয়। ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট আমদানিসহ বর্তমানে বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা দেখানো হচ্ছে ১০ হাজার ৩৪১ মেগাওয়াট। আর উৎপাদন ক্ষমতা দেখানো হয়েছে ৯ হাজার ৭২৭ মেগাওয়াট। কিন্তু বাস্তবে সাত হাজার মেগাওয়াটের ওপরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা মোটেও সম্ভব নয়। গতকাল উচ্চ দরের কুইক রেন্টালসহ তেলচালিত প্রায় সব ক’টি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে সাত হাজার ১০৪ মেগাওয়াট। আর এ জন্য গতকাল তেল পোড়ানো হয়েছে প্রায় ৬৩ কোটি টাকার, যা এক দিনে এ যাবৎকালে সর্বোচ্চ। অথচ গতকাল সব মিলে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ব্যয় হয়েছে ৭২ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ বিভাগের ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সাশ্রয়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ছাড়া বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা থেকে সহসাই মুক্তি মিলবে না দেশবাসীর।
এ দিকে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা থাকে সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। এ সময়টাকে পিক আওয়ার ধরে সর্বোচ্চ চাহিদা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু রাত ১১টার পর থেকে বিদ্যুতের চাহিদা কমতে থাকে। কিন্তু বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের মাত্রা কমে না। বরং দিন দিন এখন বাড়ছে। আজকাল মধ্য রাতেও লোডশেডিং করা হচ্ছে। আর দিন শুরু হচ্ছে লোডশেডিং দিয়ে। প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিদ্যুৎ থাকছে না। খোদ রাজধানীতেই লোডশেডিংয়ের এ অবস্থা বিরাজ করছে। গ্রামের কথা তো বলাই বাহুল্য।
ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে নগরবাসী। লোডশেডিংয়ের কারণে শিশুদের পাশাপাশি বড়রাও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ফ্রিজে রাখা মাছ, গোশত, তরিতরকারি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ওয়াসার পানির পাম্প ঠিক মতো চালাতে না পেরে অনেক এলাকায় পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ফোন করে গ্রাহকেরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বংশাল এলাকা থেকে আবুল কাশেম জানিয়েছেন, বংশাল এলাকা যেন অগ্নিগর্ভ। প্রতি তিন ঘণ্টা পরপর বিদ্যুতের লোডশেডিং করা হচ্ছে। আর স্থায়ী হচ্ছে এক ঘণ্টা। অর্থাৎ এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকলে পরের তিন ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। একে তো তীব্র গরম, এর ওপর বিদ্যুৎ না থাকায় তারা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। ঘন ঘন বিদ্যুতের লোডশেডিং করায় আইপিএসের চার্জও থাকছে না। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর বৈদ্যুতিক পাখা কিছুক্ষণ চালু থেকে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আবুল কাশেম ক্ষোভ প্রকাশ করেন, সরকারের বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে উন্নয়নের দাবি বাস্তবে তারা দেখতে পারছেন না। অথচ তারা এক হাজার টাকার বিদ্যুৎ বিল চার হাজার টাকা গুনছেন।
মীর হাজিরবাগ থেকে আবদুল কুদ্দুস জানান, ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। লোডশেডিং স্থায়ী হচ্ছে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। সারা দিনে এদিক সেদিক কাটানো যায়। কিন্তু রাতে তো বাইরে বের হওয়া যায় না। লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায় ঘরে থাকাও দায় হয়ে যায়। এর পাশাপাশি, মশার উপদ্রবতো রয়েছেই। সব মিলে টিকাই দায় হয়ে পড়েছে।
পূর্ব ধোলাইপার থেকে বাপ্পী জানিয়েছেন, সারা দিনের লোডশেডিংয়ের মাত্রা বোঝা যায় না। কারণ, অফিস চলাকালীন লোডশেডিংয়ের সময় জেনারেটর চালানো হয়। কিন্তু বাসায় গেলে বোঝা যায় লোডশেডিংয়ের মাত্রা। তিনি জানান, গ্রীষ্মের উত্তাপ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় তাদের টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে। গরমে শিশুদের পাশাপাশি বড়রাও অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
বংশাল, মীরহাজিরবাগ, ধোলাইপারের মতো রাজধানীর সব এলাকায়ই একই অবস্থা। মিরপুর থেকে শিবল জানিয়েছেন, একে তো ভ্যাপসা গরম, এর ওপর ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে ফ্রিজে রাখা তরিতরকারী, মাছ, গোশত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পানির পাম্পও চালানো যাচ্ছে না। এর ফলে পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
ঢাকার একাংশের বিদ্যুৎ বিতরণে নিয়োজিত কোম্পানি ডেসকোর এমডি আরজাদ হোসেন গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় অধিক চাহিদা মেটাতে বাড়তি বিদ্যুৎ সরবরাহের ফলে স্থানীয়ভাবে বিদ্যুৎ বণ্টনের জন্য যন্ত্রপাতি অতিরিক্ত গরম হয়ে যায় বলে সেগুলোকে ঠাণ্ডা করতে কিছু সময় বন্ধ করে রাখতে হয়। তবে তিনি বলেন, উৎপাদনের কোনো ঘাটতি ছিল না।
অন্য এক কর্মকর্তা জানান, তাপমাত্রা না কমলে বিদ্যুতের এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। তিনি বলেন, বৃষ্টি হলেই সমস্যা কেটে যাবে।