তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন পানি বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতিবিদরা। একই সাথে এ বিষয়ে ভারতের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরেন তারা।
গতকাল রাজধানীর হোটেল পূর্বাণীতে বিএনপি আয়োজিত ‘তিস্তা নদীর পানি বণ্টন : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনা সভায় বক্তারা এ কথা বলেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন পানি বিশেষজ্ঞ ড. এস আই খান, ভারতে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মাসুদ আজিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, নিউ নেশন পত্রিকার সাবেক সম্পাদক মোস্তফা কামাল মজমুদার, সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ প্রমুখ। আইইবির সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী আ ন হ আখতার হোসেনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো: সাব্বির মোস্তফা খান।
এ ছাড়া বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আর এ গণি, এম কে আনোয়ার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রোভিসি অধ্যাপক ড. আ ফ ম ইউসুফ হায়দার, ড. তাহমিনা আক্তার টফি, খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, শিক্ষা সম্পাদক খায়রুল কবীর খোকন, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক মীর সরফত আলী সপু প্রমুখ আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন।
লংমার্চ হবে জনকল্যাণে : মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, মানুষের কল্যাণের জন্য বিএনপি লংমার্চ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। জনগণকে সাথে নিয়েই পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিএনপি রুখে দাঁড়াবে।
তিনি বলেন, একদিকে অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চলবে, অন্যদিকে তিস্তাসহ সব ধরনের অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য দাবি আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরা হবে।
মির্জা ফখরুল বলেন, অনেকই প্রশ্ন করেছেন লংমার্চের মতো কর্মসূচি সময়োপযোগী কি না। আমি বলি, এখনই সময়। কারণ উত্তরাঞ্চলের প্রায় তিন কোটি কৃষক তাদের ফসল উৎপাদনে সেচের পানি পেতে ঘাম ঝরাচ্ছেন। পরিবেশসহ সার্বিক পরিস্থিতি এখন চরম হতাশাজনক। তিনি বলেন, ভারতের নির্বাচন নিয়ে বসে থাকার কারণ নেই; তাদের নীতি একই।
ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা করে তিনি আরো বলেন, লংমার্চ নিয়ে শাসকগোষ্ঠীর মন্ত্রী-এমপিরা অযাচিত সব বক্তব্য দিচ্ছেন। পানি নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা নেই। কারণ তারা জনগণের আস্থা ও সমর্থনে টিকে নেই; তাদের টিকে থাকার শক্তিই হচ্ছে ভারত। আর ভারতকে খুশি করতেই এ সরকার সব কাজ করতে হচ্ছে।
ভারতকে চাপ দিতে হবে : তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, অনেকে বলে থাকেন যে, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আন্তর্জাতিক কোনো আইন নেই। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আদালতে যাচ্ছে না কেন?
তিনি বলেন, আসলে আইন আছে। তবে অভিন্ন নদীর পানি প্রাপ্তিতে আমাদের আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই বরং আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করা যেতে পারে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় বিষয়টি উপস্থাপন করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রথাগত আইন, জীববৈচিত্র্য আইন, পরিবেশ আইন, জলবায়ু আইনগুলোকে সামনে আনা যেতে পারে।
আসিফ নজরুল বলেন, সরকারের আত্মমর্যাদা ও দেশপ্রেম থাকলে এখনই তারা চাপ সৃষ্টি করতে পারে। কারণ আন্তর্জাতিক আইন আছে।
তিনি আরো বলেন, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনে যেভাবে চাপ তৈরি করতে পেরেছিলেন, সেভাবে আবারো এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া দরকার। কারণ, দেশের মানুষের পক্ষে দাবি তুলে ১৯৭৭ সালে গঙ্গা চুক্তির বিষয়টি বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরেছিলেন জিয়াউর রহমান। তার ফলে জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে গঙ্গা চুক্তি হয়েছিল।
তিনি বলেন, গঙ্গা চুক্তির আর্টিকেল ৬ অনুযায়ী অভিন্ন নদীর পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো দেশই এককভাবে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, যেখানে অন্য দেশের ক্ষতি হয়। সেভাবে বাংলাদেশ, ভারত বা চীনের মধ্যে অভিন্ন নদীর ক্ষেত্রে একপাক্ষিকভাবে কেউই বাঁধ তৈরি করতে পারে না।
তিনি বলেন, ভারত কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাইলে অবশ্যই এর আগে বাংলাদেশের সাথে আলোচনা করতে হবে। প্রথাগত আইন, পরিবেশ আইন অনুযায়ী ভারত কোনো প্রকল্প নিতে পারে না।
তিনি আরো বলেন, সরকার নিজেই যখন নতজানু হয়ে ভারতকে সব দিয়ে দিতে চায় তখন অন্য দেশকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। যদি বাংলাদেশে কোনো দায়িত্বশীল সরকার আসে সে ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে ভারতের কাছ থেকে ন্যায্য অভিন্ন নদীর পানি পাওয়া সম্ভব।
ড. আসিফ নজরুল বলেন, ভারত আন্তর্জাতিক নদী আইন লঙ্ঘন করছে। কিয়োটো প্রটোকলে বাংলাদেশ অভিযোগ করলে ভারত চাপের মুখে থাকবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইস্যুগুলো তুলতে হবে তবেই প্রতিকার পাওয়া যাবে। লংমার্চ কর্মসূচির জন্য বিএনপিকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মাসুদ আজিজ বলেন, ভারতে কংগ্রেসের পরিবর্তে বিজেপি ক্ষমতায় এলেই বাংলাদেশের পানি প্রাপ্তির বিষয়ে নজর দেবে এমন ভাবার অবকাশ নেই। কারণ তাদের মূল দৃষ্টি থাকবে পাকিস্তান ও চীনের দিকে। তাই পানি পাওয়ার জন্য আগে জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন।
বিএনপির লংমার্চ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তিস্তার পানি পাওয়ার জন্য লংমার্চ এখনই বড় ধরনের প্রভাব না ফেললেও ভবিষ্যতে ভারতের জন্য এটি চাপের কারণ হয়ে থাকবে।
জাতীয় ঐক্য না থাকলে শুধু কূটনীতির ওপর নির্ভর করে পানি প্রাপ্তির আন্দোলন কতটা সফল হবে এ প্রশ্ন রাখেন তিনি।
তিস্তা নদী শুকিয়ে যাওয়ায় ওই এলাকায় যে ধরনের পরিবেশগত সঙ্কট এবং ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে ক্ষতি হচ্ছে সেসব বিষয় তুলে ধরে বিশিষ্ট সাংবাদিক ড. মাহফুজ উল্লাহ বলেন, তিস্তার কারণে বছরে পরিবেশগত ক্ষতি হচ্ছে সাড়ে ১২ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। ভবিষ্যতে এ পরিসংখ্যান আরো বাড়বে। তিনি বলেন, তিস্তা ইস্যুতে জনসম্পৃক্ততা প্রয়োজন; বিএনপি সেটা কতটুকু পারবে দেখার বিষয়।
মোস্তফা কামাল মজুমদার বলেন, নদীপ্রবাহ বন্ধ হলে দেশের সর্বনাশ হয়ে যাবে। এ জন্য এখনই এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।
রুহুল কবীর রিজভী বলেন, যে সরকার ভারতের শক্তিতে টিকে আছে সে সরকার ভারতের কাছে তিস্তা নিয়ে দাবি তুলবে না। এ দাবিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
হাফিজ উদ্দিন বলেন, ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় এলে তারা আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। এটি বাস্তবায়ন হলে দেশের মৃত্যুঘণ্টা বেজে যাবে। অথচ এ দেশে সরকারের ভাবখানা এমন তারা বিষয়টি জানেই না।
তিনি বলেন, দেশবাসী বিএনপির দিকে তাকিয়ে আছে। যেভাবেই হোক তিস্তার পানি চাই। অন্য কেউ এসব বিষয়ে কথা বলবেন না। এটা আমাদের জীবন-মরণ সমস্যা। তাই কূটনীতিকীকরণ বা আন্তর্জাতিকীকরণ যেভাবেই হোক বিএনপিকেই নেতৃত্ব দিয়ে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে হবে।