এবার দুর্নীতির বেড়াজালে জনতা ব্যাংক

0
191
Print Friendly, PDF & Email

সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর এবার রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের একের পর এক দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আসছে। কখনো ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে, কখনো দুর্বল প্রকল্পে ঋণ দিয়ে আবার কখনো ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা না করে উল্টো ঋণ দিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের ব্যাংকের তহবিল তসরুপ করার সুযোগ করে দিয়েছেন একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা।

শুধু তাই নয়, কয়েক বছরে বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে জনতা ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে ব্যাংকটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধেই। সরকারি একটি সংস্থার কর্মচারীদের ভবিষ্য তহবিলের নামে ভুয়া অ্যাকাউন্টে টাকা উত্তোলন করে কয়েক কোটি পকেটে পুরেছেন অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। রপ্তানি বিলের মূল্য প্রত্যাবাসিত না হওয়া সত্ত্বেও নগদ সহায়তা প্রদান, অবসর গ্রহণের পরও ব্যাংকের দায় আদায় না করে এফডিআর করার সুযোগ দিয়ে ব্যাংকের ক্ষতি করা হয়েছে কয়েক কোটি টাকা। এমনকি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই ব্যাংকের তহবিল থেকে ব্যক্তি কর পরিশোধ করার অভিযোগ উঠেছে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। ঋণ প্রদান ও আদায়ের ক্ষেত্রেও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। আর্থিক সক্ষমতা ও প্রকল্প যাচাই না করেও সীমার বাইরে ঋণ মঞ্জুর, পুনঃ তফসিল নীতিমালা উপেক্ষা করে ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই বারবার পুনঃ তফসিল সুবিধা প্রদান করে সীমার অতিরিক্ত দায় সৃষ্টিসহ বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম হয়েছে জনতা ব্যাংকে।

এদিকে হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপের মতো বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ থাকলেও অনিয়মের মাধ্যমে জনতা ব্যাংকের টাকা সরাসরি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আত্মসাতের ঘটনায় বিস্মিত অর্থ মন্ত্রণালয়ও। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর কারণেই হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপের মতো বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারি ঘটছে। একই কারণে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ও অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।

জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের এসব অভিযোগ পাওয়া গেছে বাণিজ্যিক অডিট নিরীক্ষায়। ব্যাংকটির বিভিন্ন শাখায় অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে যেসব অডিট আপত্তি দীর্ঘদিন ধরে অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়ে গেছে ওইসব অভিযোগ দ্রুত নিষ্পত্তি করার পাশাপাশি দোষী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণেরও সুপারিশ করা হয়েছে অডিট রিপোর্টে। সম্প্রতি এ ধরনের একাধিক রিপোর্ট বাণিজ্যিক অডিট অধিদফতর থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

অভিযোগ এক : বিআইডাব্লিউটিএ-এর কর্মচারীদের ভবিষ্য তহবিল নামে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকা সত্ত্বেও বিধিবহির্ভূতভাবে জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে দলীয় বীমা নামে একটি হিসাব খোলা হয়। ওই হিসাবে জমার মাধ্যমে ২০ কোটি ৬২ লাখ ১৯ হাজার ৬৭৬ টাকা আত্দসাৎ করা হয়েছে। অভিযোগ দুই : অবসর গ্রহণের পরেও ব্যাংকের দায় আদায় না করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামে এফডিআর করার সুযোগ দেওয়া হয়। এ ধরনের অনিয়মের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে আরও ১৫ কোটি ৮ লাখ ৪ হাজার ৮০০ টাকা। অভিযোগ তিন : দীর্ঘদিনের রপ্তানি বিলের মূল্য প্রত্যাবাসিত না হওয়া সত্ত্বেও নগদ সহায়তা প্রদান করা হয়। এ ধরনের অনিয়মের মাধ্যমে সরকারের ১ কোটি ৭৯ লাখ ৭৬ হাজার ১০৫ টাকা আত্দসাৎ করা হয়েছে। অভিযোগ চার : অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার ওপর আয়কর পরিশোধ করা হয়েছে ব্যাংকের তহবিল থেকে। এ ধরনের অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংকের ৫ কোটি ৯০ লাখ ১৪ হাজার ৮০৯ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। অভিযোগ পাঁচ : একটি লিমিটেড কোম্পানির নামে মঞ্জুরিকৃত ঋণের টাকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত না করেই আমদানি এলসি স্থাপন এবং পুনঃ তফসিলিকরণের পর পিএডি ঋণের দায় আদায়ে ব্যর্থ হওয়ায় ব্যাংকের প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অভিযোগ ছয় : প্রকল্প ব্যর্থতায় রুগ্ন হওয়া শিল্পের অর্থ আদায়ে আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়ায় প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ঋণ আদায়ে কর্মকর্তাদের অবহেলা ছিল বলে মনে করা হচ্ছে। অভিযোগ সাত : ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুসারে কোম্পানি চেয়ারম্যানের মৃত্যুর কারণে হস্তান্তরিত পরিচালক থেকে সমপরিমাণ শেয়ারের ঘোষণা অনুযায়ী মূলধন কার্যকর করতে না পারায় প্রকল্প ঋণ হিসেবে দেওয়া ১ কোটি ৫০ লাখ ৫৭ হাজার ২৪৩ টাকা আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অভিযোগ আট : গ্রাহকের আর্থিক সামর্থ্য বিচার না করেও প্রতিষ্ঠানের নামে প্রকল্প ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন পরেও উৎপাদনে যেতে না পেরে রুগ্ন শিল্প হওয়ায় ব্যাংকের প্রায় ক্ষতি ১৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকা অনাদায়ী হয়ে পড়েছে। অভিযোগ নয় : বাংলাদেশ ব্যাংক ও জনতা ব্যাংক লিমিটেডের ঋণ পুনঃ তফসিল নীতিমালা উপেক্ষা করে খেলাপি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ মঞ্জুর এবং আংশিক ডাউন পেমেন্ট নিয়ে পুনঃ তফসিল সুবিধা প্রদান করায় ব্যাংকের ক্ষতি প্রায় ২২ কোটি টাকা। অভিযোগ দশ : স্বীয় গ্রুপভুক্ত আটটি কার্যাদেশের বিপরীতে কোম্পানির নামে ঋণ বিতরণ এবং বারবার ঋণসীমা বর্ধিত করাসহ পুনঃ তফসিল সুবিধার মাধ্যমে ঋণ পরিশোধে কালক্ষেপণের সুযোগ দিয়ে ব্যাংকের প্রায় ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি করা হয়েছে। তবে বেশকিছু অনিয়ম ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি অনাদায়ী ঋণ সমন্বয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করায় কয়েকটি অভিযোগের আপত্তি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে অডিট বিভাগ। এ ছাড়া দশ নম্বর অভিযোগে উল্লেখিত সুদ মওকুফের আলোকে আদায়যোগ্য অর্থ নগদে আদায় করে ঋণ সমন্বিত করা হয়েছে বলে ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হলেও এর সপক্ষে কোনো ট্রান্সফার চেকের কপি ও ব্যাংক বিবরণী দেখানো হয়নি অডিট বিভাগকে।

এদিকে, জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্তৃক ব্যাংকের তহবিল আত্দসাতের বিষয়টি স্বীকার করেছেন ব্যাংকের এমডি এস এম আমিনুর রহমান। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিআইডাব্লিউটিএ-এর কিছু কর্মচারী ও ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তা মিলে যৌথ অ্যাকাউন্ট খুলে ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ করেন। অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলাসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি। বলেন, বেশির ভাগ অভিযোগ কয়েক বছরের পুরনো। পরিচালনা পর্ষদ, ব্যাংক প্রশাসন ও গ্রাহকদের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের মাধ্যমে বিভিন্ন অভিযোগ নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

শেয়ার করুন