++তেজগাঁও কলেজের ছাত্রদল নেতা ঝন্টু অপহূত হন ৬ ডিসেম্বর ++’আমরা আশায় বুক বেঁধে
আছি, আমার ভাই ফিরে আসবে’ ++চার বছরে অপহূত হয়েছেন ২৬৮, খোঁজ নেই ১৮৭ জনের
রাস্তায় পিকেটিং করার পর ওরা হারিয়ে গেলো। কিভাবে তারা হারিয়ে গেলো পরিবার এখনও জানে না। তারা মারা গেছে নাকি বেঁচে আছে এ নিয়ে পরিবার দ্বিধা দ্বন্দ্বের মধ্যে আছে। গুম হওয়া এই ব্যক্তিদের পরিবার এখন প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে। গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে সরকার বিরোধী আন্দোলনে এরা রাস্তায় পিকেটিং করে। কেউ কেউ পুলিশের ওপর হামলা চালায়। রাস্তায় পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। কেউবা মিছিল বের করার পর পুলিশের সাথে সংঘর্ষ হয়। এসব ঘটনার ভিডিও ও স্থির ছবি টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। এরপরই বিভিন্নস্থান থেকে তারা নিখোঁজ ও অপহূত হয়ে যান। কেউ বাসার সামনে থেকে আবার কেউ বাড়ি ফেরার পথে নিখোঁজ হন। কাউকে আবার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় ‘প্রশাসনের লোক’ পরিচয় দিয়ে। আইন ও সালিস কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী গত চার বছরে ২৬৮ জন অপহূত হওয়ার পর এখনও ১৮৭ জনের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তীব্র যন্ত্রণাদায়ক প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন এসব পরিবারের সদস্যরা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির ( বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিক অপহরণের ৩৫ ঘন্টা পর ফেরত পাওয়ায় এই গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা আশা করছেন, তাদের সন্তানরাও ফিরে আসবে। তাদের প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হবে।
নিখোঁজ হওয়া একজন তরিকুল ইসলাম ঝন্টু। তিনি তেজগাঁও কলেজ ছাত্রদল শাখার যুগ্ম সম্পাদক। গত বছর সরকার বিরোধী আন্দোলনে ফার্মগেট ও কাওরানবাজার এলাকায় তিনিই আন্দোলনে ছিলেন। বিশেষ করে হরতালে পিকেটিং করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কাওরানবাজার এলাকায় বাসে পিকেটিং করার ছবি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়। ৬ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ১০ টার দিকে ঝন্টু তাদের দক্ষিণখানের ২০৩, মধ্য মোল্লারটেক বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেননি। তাদের বাড়ির সামনের একজন দোকানদার জানান, ঐ সময় একটি মাইক্রোবাস থেকে তিন চার জন ঝন্টুকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। রাতে ঝন্টু বাসায় না ফিরলে তাদের পরিবারের সদস্যরা খুঁজে কোথাও পাননি।
ঝন্টুর ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম মিঠুন জানান, এলাকাবাসীর সঙ্গে তারা কথা বলে জানতে পারেন যে বাড়ির সামনের রাস্তা থেকে তার ভাইকে ধরে নেয়া হয়েছে। তবে কারা ধরে নিয়েছে-এ ব্যাপারে তারা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছে না। এ ঘটনার ৩ দিন পর তার মা হাসিনা বেগম দক্ষিণ খান থানায় একটি জিডি করেন। ঝন্টুর ভাই জানান, তিনি রাজধানীর অন্তত ১৫ টি থানায় সন্ধান করেছেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে যোগাযোগ করলে তাকে জানানো হয় যে, ঐ নামে কাউকে আটক করা হয়নি। পরে তিনি উত্তরাস্থ র্যাব-১ কার্যালয়ে একটি লিখিত অভিযোগ দেন। এই অভিযোগটি র্যাবের একজন ক্যাপ্টেন তদন্ত করেন। এক সপ্তাহ পর র্যাব থেকে জানানো হয় যে, তরিকুল ইসলাম ঝন্টু নামে কোন ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ঝন্টুর বাবা নূর মোহাম্মদ খান একটি ওষুধ উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। তিনি গতকাল ইত্তেফাককে জানান, ‘৩৫ ঘন্টা পর যদি বেলা’র নির্বাহী পরিচালকের স্বামী আবু বকর সিদ্দিক ফিরে আসতে পারেন, তাহলে আমার ছেলেও একদিন ফিরে আসবে। আমার ছেলেকে ফিরে পেতে আমি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’
গত ১১ ডিসেম্বর পল্লবীর বি ব্লকের ৯ নম্বর রোডের ৫ নম্বর বাড়ি থেকে রাত একটার দিকে ‘প্রশাসনের লোক’ পরিচয় দিয়ে কে বা কারা সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সভাপতি সেলিম রেজা পিন্টুকে ধরে নিয়ে যায়। এই বাড়িটি ছিল পিন্টুর মেজো ভাই আসলাম রেজার। সূত্রাপুর এলাকায় সরকার বিরোধী আন্দোলনে পিকেটিংয়ে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে পিন্টু এই বাড়িতে মাঝে মধ্যে আত্মগোপন করতেন। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সূত্রাপুরের কাঠের পুলের নতুন রাস্তায় সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের নেতৃত্বে একটি মিছিল বের হয়। ঐ মিছিলে পুলিশ বাধা দিলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। মিছিলে এসময় পরপর কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এই সংঘর্ষের ঘটনার দৃশ্য কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলে দেখানো হয়। পিন্টুও ঐ দৃশ্য টেলিভিশন চ্যানেলে দেখেছিলেন বলে দাবি করেন তার ভাই ইসমাইল রেজা। এ ঘটনার কয়েকদিন পর পল্লবীতে ভাইয়ের বাসা থেকে ‘প্রশাসনের লোক’ পরিচয় দিয়ে ৫/৬ ব্যক্তি পিন্টুকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর আর পিন্টু ফিরে আসেনি।
অপহূত হওয়ার মাত্র ৭ মাস আগে নুহাস নামে এক তরুণীকে পিন্টু বিয়ে করেন। হাতের মেহেদীর রঙ মুছতে না মুছতে স্বামী বেঁচে আছেন কিনা তাও জানেন না। পিন্টুর বাবা সূত্রাপুরের কাঠের পুল এলাকায় মোটর পার্টস ব্যবসায়ী সোলায়মান রেজা পরে ছেলের খোঁজে পল্লবী থানা ও র্যাব সদর দফতরে যোগাযোগ করেন। পিন্টুর ভাই ইসমাইল রেজা জানান, পুলিশ, র্যাব ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাথে যোগাযোগ করা হলে কেউই তার ভাইয়ের সন্ধান দিতে পারেনি। পিন্টুর বোন রেহানা বানু মুন্নী ভাইয়ের সন্ধানে র্যাব-৪ কার্যালয়ে যান। সেখান থেকে জানানো হয় যে, পিন্টু নামে কাউকে আটক করা হয়নি।
গত ৪ ডিসেম্বর রাতে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার আই ব্লকের নির্মাণাধীন বাড়ি থেকে তেজগাঁওয়ের ২৫ নম্বর ওয়ার্ড (সাবেক ৩৮) বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমনকে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা উঠিয়ে নিয়ে যায়। ঘটনার সময় সুমন তার খালা নীলুফার পুতুলের বাড়ির নির্মাণ কাজ দেখাশুনা করছিলেন।
গতকাল সুমনের বোন মারুফা ইসলাম ইত্তেফাককে জানান, সুমনকে উদ্ধারের ব্যাপারে র্যাব সদরের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তাদের পরিবার র্যাব মহাপরিচালকের সাথে দেখা করেছেন। র্যাব সুমনকে উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে র্যাব মহাপরিচালক তাদের জানিয়েছেন। গতকাল সুমনের মা হাজেরা খাতুন ও তিনি র্যাব-১ এর পরিচালক লে.কর্নেল কিসমত্ হায়াতের সঙ্গে দেখা করেছেন। র্যাব থেকে জানানো হয়েছে যে, সুমনকে উদ্ধারের জন্য সম্ভাব্য কয়েকটি স্থানে অভিযান চালানো হবে। সুমনের বোন জানান, ‘বেলার নির্বাহী পরিচালকের স্বামী অপহরণের পর ফেরত পাওয়ার ঘটনায় আমরাও আশায় বুক বেঁধেছি। অপেক্ষা করছি কবে সুমন ফিরে আসবে।’
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত চার বছরে সারাদেশে ২৬৮ জন অপহূত হয়েছে। এর মধ্যে ৪৩ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। অপহরণের পর ছেড়ে দেয়া হয় ২৪ জনকে। পরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয় ১৪ জনকে। কিন্তু ১৮৭ জনের এখন পর্যন্ত কোন খোঁজ নেই। আসকের তথ্য অনুযায়ী ২০১৩ সালে ৬৮ জনকে অপহরণ করা হয়। এর মধ্যে পরে পাঁচজনের লাশ উদ্ধার এবং ছয়জন ছাড়া পেলেও বাকি ৫৫ জনের এখনও খোঁজ নেই।