প্রতারণার অভিযোগে রাজধানীর নিউমার্কেট ও গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থেকে কথিত জিনের বাদশা ও তার সহযোগীকে গ্রেফতার করেছে র্যাব
গভীর রাতে একটা ফোনকল। এরপর কিছুণ ধর্মের অমিয় বাণী। তারপর সাত রাজার ধনের মিথ্যা স্বপ্ন দেখানো। তারপরের ঘটনা অনেকেরই জানা। এভাবেই জিনের বাদশার পরিচয় দিয়ে দিনের পর দিন এমন প্রতারণা করছে একটি চক্র। আর হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। নানান ধরনের ধর্মের বাণী শোনালেও এরা মূলত ভণ্ড জিনের বাদশা। বিভিন্ন অপরিচিত মোবাইল নম্বরে ফোন করে এরা মানুষকে ফাঁদে ফেলে।
র্যাব সূত্র জানায়, উত্তরাঞ্চলে এ ধরনের জিনের বাদশার এলাকা হিসাবে খ্যাত বগুড়ার মহাস্থানগড় ও শাহ সুলতানের মাজার। তবে জিনের বাদশা চক্রের সব থেকে বড় ঘাঁটি হচ্ছে গাইবান্ধা জেলার বালুয়া, বিশুবাড়ি, কালিতলা, হরিতলা, তালুককানুপুর, জামালপুর, কোমরপুরসহ পলাশবাড়ির জুনদহ এলাকা। এসব প্রতারক চক্র জিনের বাদশারা চট্টগ্রাম, সিলেট, যশোর, খুলনা, ফেনী লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রবাসীর স্ত্রী, ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর স্ত্রী ও কন্যাসহ লোকজনের মোবাইল নম্বর কৌশলে সংগ্রহ করে দীর্ঘ দিন ধরে প্রতারণা করে যাচ্ছে।
এমনি একটি চক্রকে রাজধানীর নিউ মার্কেট ও গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। তারা হলেনÑ কথিত জিনের বাদশা আবু মিয়া ও তার সহযোগী মিলন মিয়া। গত শুক্রবার রাতে তাদের গ্রেফতার করেন র্যাব-২ এর সদস্যরা। এ সময় তাদের কাছ থেকে দু’টি কথিত স্বর্ণের মূর্তি, চার লাখ টাকা লেনদেনের বিকাশের রসিদ ও দু’টি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। গতকাল দুপুরে র্যাব-২ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়।
র্যাব-২ এর অপারেশন অফিসার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রায়হান উদ্দিন খান জানান, একটি চক্র গভীর রাতে লোকজনের মোবাইলে ফোন করে নিজেকে জিনের বাদশা পরিচয় দেয়। পরে ভুয়া দোয়া কালাম পড়ে বিভিন্ন কায়দায় বিপুল সম্পদের মালিক বানিয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখানো হয়। পরে তাদের দেয়া বিকাশ নম্বর অথবা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। কল্পনা আক্তার সুইটি নামে এক নারীকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে চার লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় জিনের বাদশা। পরে আরো ১০ লাখ টাকা দাবি করলে বিষয়টি তিনি র্যাবকে জানান। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাবের একটি দল নিউ মার্কেট এলাকা থেকে কথিত ওই জিনের বাদশার ভাই আবু মিয়াকে গ্রেফতার করে। এ সময় তার কাছ থেকে দু’টি ভুয়া স্বর্ণের মূর্তি পাওয়া যায়। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থেকে মিলন মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়।
রায়হান উদ্দিন খান জানান, জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছেন, জিনের বাদশা প্রতারক চক্রের মূল হোতা আজমল আগে পুতুল ব্যবসায় করত। পিতলের পুতুলকে স্বর্ণের বলে চালিয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতো। দুই বছর ধরে এই চক্রটি জিনের বাদশা পরিচয় দিয়ে শতাধিক মানুষকে প্রতারিত করেছে। আজমলের সহযোগী হিসেবে কাজ করে শহিদুল মিয়া, মিলন মিয়া, সাবু মিয়া, শাহিন মিয়া, ফরিদুল মিয়া, আমিরুল ইসলাম ও ঠাণ্ডা মিয়া। তাদের প্রত্যেকের কাছে ৫০টির বেশি সিম রয়েছে। এই সিম দিয়ে তারা দিনে অজ্ঞাত নম্বরে ফোন করে জেনে নিতো স্থান ও নাম। পরে গভীর রাতে ফোন করে নিজেকে জিনের বাদশা পরিচয় দিয়ে বলত, বাবারে আমি জিনের বাদশা বলছি। তুই বড়ই ভাগ্যবান। সাত ডেক্সি (পাত্র) টাকা পাবি। একটা স্বর্ণের পুতুল পাবি। কোটিপতি হয়ে যাবি। সারা জীবন পায়ের ওপর পা তুলে বসে বসে খাবি। এই সম্পদ তোর নামে লেখা হয়েছে। তুই ছাড়া অন্য কেউ ভোগ করতে পারবে না। অন্য কাউকে বলতেও পারবি না। কারও সাথে আলাপ করলে তোর বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে। মাজারে সিন্নি খাওয়াতে হবে, পশু কোরবানি দিতে হবে। এ জন্য চার লাখ টাকা বিকাশ করে দে। নইলে তোর ওপর আল্লাহর গজব নাজিল হবে। তুই ধ্বংস হয়ে যাবি। রানা প্লাজার মতো তোর দালানকোঠা ধসে পড়বে। গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে তোর ছেলেমেয়ে মারা যাবে।
তিনি আরো জানান, গ্রেফতারকৃত জিনের বাদশা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, গোবিন্দগঞ্জের দরবস্ত ইউনিয়নের প্রায় সব গ্রামের বাসিন্দা এই ধরনের প্রতারণার সাথে জড়িত। তাদের আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে এভাবে জিনের বাদশা ও তার অদৃশ্য ক্ষমতার ভয়াবহতা দেখিয়ে মানুষকে বশীভূত করে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়া।