গুম ও অপহরণ আতঙ্কে চরম উদ্বিগ্ন দেশের মানুষ। যখন তখন যে কোনো স্থান থেকে যে কেউই গুম হয়ে যাচ্ছেন; অপহরণ হয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশজুড়ে গুম ও অপহরণের নতুন এই আতঙ্ক শুরু হয়। বিশেষ করে বিরোধী জোটের নেতা-কর্মীদের টার্গেট করে শুরম্ন হয় গুম। সাদা পোশপাকে অপহরনের পর আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কখনো কারো কারো লাশ পাওয়া যায়, আবার অনেকেই পরিবারের কাছে আর ফিরে আসেনি। তাদের ভাগ্যে কি জুটেছে তা কেউ জানে না। যেমনটি হয়েছে সিলেটের বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী বা রাজধানীর বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমসহ বিরোধী জোটের বহু নেতাকর্মীর ক্ষেত্রে।
পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী রেজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিককে অপহরণের পর দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। অপহরণের ২৫ ঘন্টার মাথায় বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টারদিকে অপহরণকারীরা তাকে চোখ বেঁধে ধানমন্ডি এলাকায় রাসত্মায় ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় রেজওয়ানা হাসান গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে নিজ বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেন, তার স্বামীকে অপহরণের বিষয়টি রহস্যজনক। তিনি ও তার পরিবার এখনো নিরাপত্তাহীন। সরকারের কাছে তিনি নিরাপত্তা চেয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতা কর্মীরা ছাড়াও ব্যবসায়ী, ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক, নারী এমনকি শিশুরাও অপহরণ বা গুমের শিকার হচ্ছেন। ফলে একটা সার্বক্ষণিক আতঙ্কে দিন কাটাতে হচ্ছে সমাজের প্রায় প্রতিটি পরিবারকে। অপহরনের সর্বশেষ শিকার হলেন, বিশিষ্ট পরিবেশ আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিক। আবু বকর সিদ্দিককে অপহরণ করা হয় বুধবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জ থেকে তার নিজের গাড়ীতে ঢাকা ফেরার পথে। নানামুখি চাপে অপহরণকারীরা তাকে অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে দেয়।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিরোধী মতের মানুষ যাতে ভয়ে কথা বলতে না পারে সেজন্যই সরকার গুম-অপহরণের ঘটনা ঘটাচ্ছে। তিনি বলেন, বিএনপির জনপ্রিয় নেতা এম ইলিয়াস আলী ও ডিসিসি কমিশনার চৌধুরী আলমসহ ৬১ জনকে গুম করা হয়েছে। বেলা’র নির্বাহী পরিচালক রিজওয়ানা হাসানের স্বামীকে অপহরণ করা হয়েছে। আসলে সরকার বিরোধী মতের মানুষের মধ্যে ভয় তৈরি করতে চায়, যাতে কেউ সরকারের বিরম্নদ্ধে কথা বলতে সাহস না পায়। বুধবার বিকালে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম. ইলিয়াস আলীর সন্ধান দাবিতে বিএনপি আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। বৃহস্পতিবার অপর একটি সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া মন্তব্য করেন।
এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, দেশে চলমান খুন ও গুমের অবস্থা দেখে মনে হয় গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনও গুম হয়ে গেছে। দুই বছরেও বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর খোঁজ না দেওয়ার প্রতিবাদে স্বাধীনতা ফোরামের এক সমাবেশে তিনি এই মন্তব্য করেন। তিনি আরো মন্ত্মব্য করেন, ‘র’ এর এজেন্ট এসে বাংলাদেশ থেকে একজনকে ধরে নিয়ে যায়। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, তিনি এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। তা হলে আমরা কোন দেশে বাস করছি।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকার গত ১৫ এপ্রিল তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০১৩ সালে দেশের ৩৫ জন নাগরিক গুম হয়েছেন। এ বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত আরো ছয়জন নাগরিক গুম হয়েছে বলে তাদের স্বজনেরা অভিযোগ করেছেন। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাজধানীর বনানী থেকে গুম হন ইলিয়াস আলী। দুই বছরে তার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। সেই থেকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তদন্ত চলছে। বনানী থানার ওসি বলেছেন, তদন্ত এখনো চলছে। আমরা নিয়মিত আদালতে প্রতিবেদন দিয়ে যাচ্ছি। তবে বৃহস্পতিবার ইলিয়াস আলীর স্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, গত দেড় বছরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্য তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। তার স্বামীর কোনো তথ্য কেউ জানাতে পারেনি।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের ২০১৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড বেড়ে যাওয়া, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর নিপীড়ন, বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ- সব মিলিয়ে ২০১৩ সালে বাংলাদেশের মানুষ চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদন ২০১৩-তে এই দাবি করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার মধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বেড়েছে। ২০১৩ সালে পুলিশ, র্যাবসহ বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ৩২৯ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়। পাঁচ বছরে এই সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ। এর মধ্যে পুলিশের হাতে সর্বোচ্চ ১৭৫ জন এই হত্যার শিকার হয়। ২০০৯ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা ছিল ১৫৪। ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত্ম বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের জড়িত থাকার কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে ২০১৩ সালে তারা ১১ জনকে হত্যা করে।