বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিক অপহরণের ঘটনায় পুলিশের শনাক্ত করা মাইক্রোবাসটির নম্বর ভুয়া। বিআরটিএ চট্টগ্রাম অঞ্চলের পক্ষ থেকে প্রথম আলোকে এ তথ্য জানানো হয়।
আবু বকর সিদ্দিক অপহরণের ঘটনায় ব্যবহূত মাইক্রোবাস শনাক্ত করার দাবি করে পুলিশ। মাইক্রোবাসটির নম্বর চট্টগ্রাম মেট্টো-গ-১৭-৮৩২৭। নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) সাজ্জাদুর রহমান আজ দুপুরে জানান, যাত্রাবাড়ীর মেয়র হানিফ উড়ালসড়কে থাকা সিসিটিভিতে ধারণ করা ফুটেজ দেখে সন্দেহভাজন মাইক্রোবাসটি শনাক্ত করা হয়েছে। নম্বরের যথার্থতা যাচাই করছে পুলিশ।
এ বিষয়ে জানতে বিআরটিএ চট্টগ্রাম অঞ্চলের অফিসে যোগাযোগ করা হলে উপপরিচালক মো. জামাল উদ্দিন বলেন, ‘নম্বরটি (চট্টগ্রাম মেট্টো-গ-১৭-৮৩২৭) ভুয়া।’
গতকাল বুধবার বেলা আড়াইটার দিকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংকরোডের ভুঁইয়া ফিলিং স্টেশনের সামনে থেকে একদল দুর্বৃত্ত অস্ত্রের মুখে আবু বকর সিদ্দিককে অপহরণ করে। রিজওয়ানা হাসান এ ঘটনায় ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা করেছেন।
আজ দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত আবু বকরের কোনো খোঁজ মেলেনি।
দেশের পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও ম্যাগসাইসাই পুরস্কারপ্রাপ্ত আইনজীবী রিজওয়ানা হাসান অভিযোগ করেন, পেশাগত কারণে তাঁর নিজের প্রতি ক্ষুব্ধ কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে তাঁর স্বামীকে অপহরণ করেছে।
অপহূত আবু বকর ফতুল্লা পোস্ট অফিস মোড়ে অবস্থিত রপ্তানিমুখী হামিদ ফ্যাশন লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক। প্রতিষ্ঠানটির মালিক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। জাতীয় শ্রমিক লীগ ফতুল্লা আঞ্চলিক শাখার সভাপতি কাউসার আহমেদ পলাশের নেতৃত্বে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে প্রতিষ্ঠানটি কয়েক বছর বন্ধ ছিল। গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে কারখানাটি পরিচালনার দায়িত্ব নেন আবু বকর।
ঘটনার বর্ণনা: প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, বেলা আড়াইটার দিকে আবু বকর সিদ্দিক নিজের কর্মস্থল থেকে লাল রঙের টয়োটা এলিয়ন গাড়িতে করে ঢাকায় ফিরছিলেন। ফতুল্লা ভূঁইগড়ে আসার পর নীল রঙের একটি মাইক্রোবাস পেছন থেকে গাড়িটিকে ধাক্কা দেয়। গাড়িটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কি না, দেখার জন্য চালক রিপন গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে একদল দুর্বৃত্ত অস্ত্রের মুখে আবু বকরকে জিম্মি করে ফেলে। তিনি কারণ জানতে চাইলে দুর্বৃত্তরা তাঁকে মারধর করে। একপর্যায়ে আবু বকরকে জোর করে তাদের মাইক্রোবাসে তুলে ঢাকার দিকে চলে যায়। দুর্বৃত্তরা তাঁর মুঠোফোন দুটি গাড়িতেই ফেলে যায়।
গাড়িচালক রিপন মিয়া জানান, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংকরোডের শিবু মার্কেট থেকে একটি মাইক্রোবাস তাঁদের গাড়ি অনুসরণ করে আসছিল। দুই কিলোমিটার আসার পর গাড়িটি ধাক্কা দেওয়া হয়। গাড়ি থেকে ছোট চুলওয়ালা ছয়-সাতজন অস্ত্রধারী নেমে পিস্তলের বাঁট দিয়ে তাঁকে আঘাত করে। চোখে মরিচের গুঁড়ার মতো ঝাঁজালো পদার্থ ছুড়ে মারে। তুলে নেওয়ার সময় আবু বকর বাঁচাও বাঁচাও চিত্কার করলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। দুর্বৃত্তরা চলে যাওয়ার পর গাড়িচালক ফোন করে আবু বকরের বাসায় ঘটনা জানান।
এরপর ঘটনাস্থলে যান জেলা পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলামসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। রিজওয়ানা হাসানও ছুটে যান সেখানে। তিনি পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে বসে স্বামীকে উদ্ধারের জন্য পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহায়তা চান।
ক্ষুব্ধ গোষ্ঠীকে সন্দেহ: রিজওয়ানা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, জানা মতে তাঁর স্বামীর কোনো শত্রু নেই। তাঁদের এমন কোনো টাকাপয়সা নেই যে, কেউ তাঁর স্বামীকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করবে। তবে পেশাগত কাজের কারণে বসুন্ধরা গ্রুপ, মধুমতি মডেল টাউন, আশিয়ান সিটি, শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনসহ কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ রয়েছে। এদের কেউ পরিকল্পিতভাবে তাঁর স্বামীকে অপহরণ করতে পারে।
রিজওয়ানা হাসান মামলায় উল্লেখ করেন, তিনি একজন আইনজীবী এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির প্রধান নির্বাহী। পেশাগত কারণে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করে আসছেন তিনি, যা অনেকের অর্থনৈতিক স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করেছে। প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে এসব মহল বিভিন্ন সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে প্রচারমাধ্যমে নানা অপপ্রচার চালিয়েছে এবং নানাভাবে তাঁকে তাঁর কাজ থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করেছে। স্বামীর নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে এসবের যোগসূত্র থাকতে পারে বলে মামলায় উল্লেখ করেন তিনি।
রিজওয়ানা হাসান জেলা পুলিশ সুপারকে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘আপনারা নারায়ণগঞ্জের টর্চার সেলগুলোতে অভিযান চালালে হয়তো তাঁর খবর পাওয়া যেতে পারে।’ জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, ‘ম্যাডাম, আজমেরী ওসমানের টর্চার সেলগুলো র্যাব বন্ধ করে দিয়েছে।’
অভিযোগ অস্বীকার: রিজওয়ানা হাসানের অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে বসুন্ধরা গ্রুপের উপদেষ্টা (প্রেস অ্যান্ড মিডিয়া) মুহা. আবু তৈয়ব প্রথম আলোকে বলেন, ‘যার সঙ্গে সামান্যতম কোনো যোগসূত্র নেই, সে বিষয়ে এমন অভিযোগ শুনে আমরা খুবই বিস্মিত হয়েছি।’
আশিয়ান সিটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের ভিত্তিহীন মন্তব্য শুনে আমরা ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত হয়েছি। আমরা প্রয়োজনে আইনগত ব্যবস্থা নেব।’
পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে ঘটনাস্থলের আশপাশের সব টহল দলকে ঘটনা জানানো হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কসহ নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন সড়কে পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহনে তল্লাশি চালাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর পুলিশ সুপার ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকেও বিষয়টি জানিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। অপহূত ব্যক্তিকে উদ্ধারে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের চারটি দল এবং ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানার পুলিশ যৌথভাবে কাজ করছে।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশ: আবু বকর সিদ্দিককে দ্রুত খুঁজে বের করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। গতকাল নিজের কার্যালয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ তাঁকে ফোন করে এই অপহরণের কথা জানান। এরপর তিনি পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) ও র্যাবের মহাপরিচালক এবং পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত মহাপরিদর্শককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।
তদন্ত কমিটি: এই অপহরণের ঘটনা তদন্তে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ১০ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) সাজ্জাদুর রহমানকে প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শহীদুল ইসলামকে সদস্যসচিব করে ১০ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।