বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৯-দলীয় জোটের শরিক দলের অর্ধেকেরও বেশি একেবারেই নিষ্ক্রিয়। বাকিরা নামে আছে, কোনো কাজে নেই। নেতা-কর্মী দূরের কথা, মাঝেমধ্যে এসব সংগঠনের শীর্ষ নেতাদেরও খুঁজে পাওয়া যায় না। একেবারেই নামসর্বস্ব নয়টি শরিক দল জেলা-উপজেলা পর্যায়ে এখনো নিজেদের অস্তিত্বই গড়ে তুলতে পারেনি। জামায়াতের অর্থায়ন ও পৃষ্ঠপোষকতায় পাঁচটি, বিএনপি নেতাদের কর্তৃক দুটি আর বিজেপির সহযোগিতায় যে একটি সংগঠন চলত, সেগুলোরও অবস্থা এখন ত্রাহি। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন নেই আটটির। আর জাতীয় সংসদে কখনোই প্রতিনিধিত্ব ছিল না ১৩টিরও বেশির। এরই মধ্যে গোস্বা করে জোট ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছে একটি।
একমাত্র জামায়াতে ইসলামী ছাড়া আর কোনোটিরই রাজপথে নামার কোনো সামর্থ্য নেই। বিজেপির ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ, এলডিপির কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, ইসলামী ঐক্যজোটের আবদল লতিফ নেজামী আর জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) শফিউল আলম প্রধান ছাড়া মিডিয়াতে পর্যন্ত কারও আওয়াজ পাওয়া যায় না। কালেভদ্রে বেসরকারি টেলিভিশনের টকশোতে দেখা যায় কল্যাণ পার্টির মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমকে। আর বাকিদের কোনো পাত্তাই নেই। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগের ও পরের আন্দোলনে মোটামুটি ঘরকুনোই ছিল ১৯-দলীয় জোটের বেশির ভাগ শরিক। এর পরও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামের একটি সংগঠন ইতোমধ্যে গোস্বা করে জোট ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছে।
জানা গেছে, বেশ কটি শরিক দল দেনদরবারসহ নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিতে নতুন করে জাতীয় প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন ও ঘরোয়া আলোচনা সভার আয়োজন শুরু করেছে। তবে লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান সম্প্রতি ১৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে জোটনেত্রীর সঙ্গে তার গুলশানের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা করে এসেছেন। সংগঠনের সামর্থ্যের কথা বিবেচনায় না আনলেও বেগম খালেদা জিয়াকে আগামী দিনের আন্দোলনে সর্বাত্দক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন তিনি। তবে বিএনপির প্রত্যাশা হচ্ছে, শীঘ্রই সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারা, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, আ স ম আবদুর রবের জেএসডি আর ড. কামাল হোসেনের গণফোরামসহ আরও বেশ কটি বাম সংগঠন তাদের জোটের অন্তর্ভুক্ত হবে। এর মধ্যে বিএনপির পরিকল্পনার সঙ্গে একাত্দতা প্রকাশ করে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে বিকল্পধারাসহ দু-একটি সংগঠন। বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের সদস্যরা জানান, রাজপথে কার শক্তি কতটুকু সেটি বড় কথা নয়, রাজনৈতিক কৌশলগত কারণেই গঠন করা হয়েছে ১৯-দলীয় জোট। সমমনা যেসব দল সরকারবিরোধী চলমান আন্দোলনের সঙ্গে একাত্দতা প্রকাশ করেছে, তাদেরই জোটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পাল্টা প্রশ্ন রেখে তারা বলেন, ক্ষমতাসীন মহাজোটের সব দল কি সমান? অন্যদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের পরিধি আগামী দিনে আরও বাড়ানো হবে বলে ইঙ্গিত দিলেন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। জানা যায়, জোটের শরিক ১৯টির মধ্যে পাঁচটি দল বাদে বাকিগুলোর সারা দেশে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কোনো অস্তিত্বই নেই। ছয়টির নির্বাচন কমিশনে কোনো নিবন্ধন নেই। পাঁচটি সংগঠনের বাইরে অন্য কারও জাতীয় সংসদে কখনো কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না। অনেকটা ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দারের মতো এদের অবস্থা। জোটের সভা-সমাবেশগুলোতেও এসব সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের মঞ্চে অবস্থান ও বক্তৃতা প্রদান ছাড়া কোনো পোস্টার-ব্যানার কিংবা নেতা-কর্মী কখনোই দেখা যায় না। জামায়াতে ইসলামীর পৃষ্ঠপোষকতা ও আর্থিক সহায়তায় চলছে জোটের শরিক এমন পাঁচটি নামসর্বস্ব সংগঠন। একটিকে সহযোগিতা করছে ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমানের বিজেপি। আরও তিনটি সংগঠনকে পৃষ্ঠপোষকতা করছেন বিএনপির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা। এভাবেই চলছে ১৯-দলীয় জোটের নয়টি সংগঠন। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে জবাবে সংশ্লিষ্ট নেতারা বলেন, ‘সমমনা সংগঠনগুলোকে সহযোগিতা না করলে করব কাকে।’ পূর্ববর্তী চারদলীয় জোটের বাইরে কর্নেল (অব.) অলি আহমদের এলডিপি, শফিউল আলম প্রধানের জাগপা, মে. জে. (অব.) সৈয়দ মো. ইবরাহিমের কল্যাণ পার্টি আর শেখ শওকত হোসেন নিলুর এনপিপি ছাড়া অন্যদের তেমন কোনো পরিচিতি ছিল না রাজনীতির মাঠে। বর্ধিত এ জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে দুই বছর ইতোমধ্যে পূর্ণ হয়েছে। অথচ বর্তমান জোটের দল ও নেতাদের পরিচয় লিখিতভাবে হাতে না পেলে বিএনপি বা আগের চারদলীয় জোটের শরিকদের কেউ তাদের নাম পর্যন্ত বলতে পারেন না। কিন্তু তারা সবাই ১৯-দলীয় জোটের সদস্য। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতে, ‘ছোট, মাঝারি বা বড় যে আকারেরই হোক না কেন, যারা আমাদের রাজনীতি ও আদর্শের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনে অংশ নিতে আগ্রহী, তাদের সবাইকে আমরা জোটে স্বাগত জানাব। এমনকি মহাজোট ছেড়ে চলে এলেও আমরা তাদের আমাদের জোটে অন্তর্ভুক্ত করব।’ ১৮-দলীয় জোট সম্পর্কে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সবচেয়ে প্রবীণ সদস্য ড. আর এ গনির মত হচ্ছে, ‘রাইট পারসন যদি একজনও হয়, তবে তাকেই বিএনপির প্রয়োজন। বাকি ৯৯ জন রং পারসন দরকার নেই। যেসব দল ও নেতা আমাদের ঐক্যের সঙ্গে এক হয়েছেন, তাদেরই আমরা এ জোটের অন্তর্ভুক্ত করেছি।’ জোটের নতুন শরিকদের অনেক নেতারই কোনো পরিচিতি নেই। তারা আসলে কারা। এমন প্রশ্নে লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘দল আছে বলেই তারা আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। এ ছাড়া সবার শক্তি ও পরিধি যে সমান হতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। তারা যদি নিজেরা স্বয়ংসম্পূর্ণই থাকত, তবে তো আর জোটে আসার প্রয়োজন ছিল না তাদের।’ বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৯-দলীয় জোটে রয়েছে বিগত চারদলীয় জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামী, মুফতি ফজলুল হক আমিনীর ইসলামী ঐক্যজোট, ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থর বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) ও মাওলানা মো. ইসহাকের খেলাফত মজলিশ। এর বাইরে বর্তমান জোটে অন্তর্ভুক্ত দলগুলো হচ্ছে কর্নেল (অব.) অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), মে. জে. (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের কল্যাণ পার্টি, শফিউল আলম প্রধানের জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগ্পা), শেখ শওকত হোসেন নিলুর ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি), খন্দকার গোলাম মোর্তজার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি), এ এইচ এম কামরুজ্জামান খানের মুসলিম লীগ, ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরানের বাংলাদেশ লেবার পার্টি, আবদুল মবিনের ইসলামিক পার্টি, শেখ আনোয়ারুল হকের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ ভাসানী), মুফতি মোহাম্মদ ওয়াক্কাসের জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, অলি আহাদের ডেমোক্রেটিক লীগ ও খাজা গরিবে নেওয়াজের নেতৃত্বাধীন পিপলস লীগ। তবে সম্প্রতি ১৯-দলীয় জোট ছেড়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) সভাপতি জেবেল রহমান গানি।