সরকারবিরোধী আন্দোলনে যারা ঢাকাকে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিলেন, বিএনপির সেই তৃণমূল নেতাদের ওপরই আগে খড়গ নেমে এসেছে। পুনর্গঠনের নামে দলের জেলা কমিটিগুলো ভেঙে দিয়ে গঠন করা হচ্ছে আহ্বায়ক কমিটি। এতে অনেক জায়গায়ই আগের কমিটির নেতারা গুরুত্ব হারাচ্ছেন। ফলে নেতাকর্মীদের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপি কি উল্টো পথে হাঁটছে? তা না হলে দলের উপরি কাঠামো ঠিক না করে পুনর্গঠনের নামে কেন তৃণমূল আগে ভেঙে দেয়া হচ্ছে!
এর আগে উপজেলা নির্বাচনের সময়ও ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ অভিযোগে সারা দেশে তৃণমূলের প্রায় ২০০ নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করে বিএনপি।
জেলা কমিটি পুনর্গঠনের এই সিদ্ধান্ত দলের কোন ফোরাম বা বৈঠকে নেয়া হয়েছে তা নিয়েও রহস্য রয়েছে। কারণ সর্বশেষ ৯ এপ্রিল স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে কিনা স্থায়ী কমিটির কোনো নেতা যুগান্তরকে নিশ্চিত করতে পারেননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক নেতা বলেন, ওই বৈঠকে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া শুধু জানিয়েছেন শিগগিরই জেলা কমিটি পুনর্গঠনের মাধ্যমে দলকে চাঙা করার উদ্যোগ নেয়া হবে। কিন্তু চেয়ারপারসনকে কারা ওই পরামর্শ দিয়েছেন তা নিয়ে দলে এখনও গুঞ্জন চলছে। কেউ বলছেন, তারেক রহমানের পক্ষ থেকে, আবার কারও মতে, নয়াপল্টন কার্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নেতাদের তৎপরতায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। গুলশান কার্যালয়ের প্রভাবশালী নেতাদের দিকেও দু-একজন আবার অভিযোগের আঙুল তুলছেন ।
গত এক সপ্তাহে সারা দেশে মোট ৮ জেলার কমিটি ভেঙে দিয়ে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে নেত্রকোনা জেলার সভাপতি আশরাফউদ্দিন খানকে আহ্বায়ক করে ৪৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হলেও সাধারণ সম্পাদককে সদস্য সচিব করা হয়নি। তাকে শুধুু সদস্য পদে রাখা হয়েছে। আন্দোলনের সময় ক্ষমসতাসীন দলের নেতাকর্মীরা তার বাসায় হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর করে। বাড়ির সব ক্রোকারিজ, বাথরুমের কমোড পর্যন্ত ওই হামলা থেকে রক্ষা পায়নি।
এছাড়া নওগাঁয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কাউকে আহ্বায়ক করা হয়নি। আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ায় সদর বিএনপির সভাপতি আবুবকর সিদ্দিক নান্নুকে জেলা কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে।
পঞ্চগড় জেলা বিএনপিতে সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট এ হাসান প্রধানকে আহ্বায়ক করা হয়েছে। সিলেটে আহ্বায়ক করা হয়েছে আগের কমিটির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট নুরুল হককে। ওই কমিটির সভাপতি ইলিয়াস আলী নিখোঁজ রয়েছেন। সাধারণ সম্পাদক আবদুল গফফারকে সদস্য পদে রাখা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় সভাপতি অ্যাডভোকেট হারুন আল রশিদ অসুস্থ থাকায় আগের কমিটির সহ-সভাপতি হাফিজুর রহমান কচি মোল্লাকে আহ্বায়ক এবং বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল হক খোকনকে সদস্য সচিব করা হয়েছে।
উপরি কাঠামো ঠিক না করে জেলা কমিটি পুনর্গঠনের উদ্যোগ সঠিক কিনা জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, তৃণমূল ঠিক করে উপরি কাঠামো ঠিক করা সুবিধাজনক। তাই আগে জেলা কমিটিতে হাত দেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবগুলো কমিটি পুনর্গঠন করা হবে।
পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত কোন ফোরামের বৈঠকে হয়েছে জানতে চাইলে ফখরুল দাবি করেন, এটি দলের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত। তবে কোন ফোরামের বৈঠকে তা বিস্তারিত বলতে রাজি হননি।
স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, সর্বশেষ স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, এবার সরকারবিরোধী আন্দোলনে তৃণমূল অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে একথা ঠিক। কিন্তু কোথাও কোথাও কোন্দলও ছিল।
ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, আসলে উপরি কাঠামো ঠিক করে তৃণমূলে হাত দিলে ভালো হতো। যাই হোক, হাইকমান্ড মনে করেছে জেলা কমিটি আগে পুনর্গঠনের। সুতরাং এটা দোষের কিছু নয়। তবে খেয়াল রাখতে হবে- আন্দোলন-সংগ্রামে জোরালো ভূমিকা পালনকারী নেতারা যেন কোনোভাবেই বঞ্চিত না হন।
নির্বাচন পূর্ববর্তী সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির জেলা-উপজেলা পর্যায়ের তৃণমূল নেতাদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাদের প্রচেষ্টাতেই আন্দোলন দানা বেঁধেছিল। প্রায় তিন মাস তারা রাজধানী ঢাকাকে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। কিন্তু ঢাকার আন্দোলন গতিশীল না হওয়া এবং দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঠিক কর্মকৌশল প্রণয়নের ব্যর্থতাই ওই আন্দোলন যৌক্তিক পরিণতি পায়নি। অথচ নির্বাচন পরবর্তী নতুন পরিস্থিতিতে মেয়াদোত্তীর্ণ সেই কেন্দ্রীয় কমিটি, দলে এখনও সেই ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, মহানগরী কমিটি, এমনকি ছাত্রদল যুবদলসহ সবগুলো অঙ্গ-সংগঠনই বহাল রয়েছে। কিন্তু দল ‘চাঙা’ করার নামে একের পর এক ভেঙে দেয়া হচ্ছে জেলা কমিটি।
অভিযোগ রয়েছে, জেলা কমিটিগুলোতে যেসব দ্বন্দ্ব বা কোন্দল বিদ্যমান তার পেছনেও রয়েছে কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী কোনো নেতার হাত। তার বা তাদের ইন্ধনেই কোন্দল টিকে রয়েছে।
২০০৯ সালের জাতীয় কাউন্সিলের পর বিএনপির ৭৩টি সাংগঠনিক জেলায় কমিটি গঠন করা হয়। একই সময় ঘোষণা করা হয় জাতীয় নির্বাহী কমিটি। ফলে দলটির প্রায় সবগুলো কমিটির মেয়াদই শেষ হয়ে গেছে। তিন বছরের বেশি সময় ধরে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দায়িত্ব পালন করছেন দলটির ‘ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব’ হিসেবে। অনেকের মতে, এতে দলটির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এদিকে সময় পার হয়ে গেলেও দলের কাউন্সিল হচ্ছে না। মহানগরী বিএনপির কমিটি ঘোষণার ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব হিমশিম খাচ্ছে। ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলসহ অঙ্গ-সংগঠন পুনর্গঠন নিয়ে রয়েছে লবিং-পাল্টা লবিং।