ইন্টারনেটে যশোরের কয়েক শ’ ছাত্রীর বিকৃত ভিডিও

0
300
Print Friendly, PDF & Email

যশোরে সাইবার ক্রাইম বাড়ছে। শিকার হচ্ছে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। সম্প্রতি জেলার সদর উপজেলার   
সূতীঘাটা কুয়াদা এলাকায় এ রকম বেশ কয়েকটি সাইবার সেন্টার থেকে কয়েক শ’ তরুণ-তরুণীর বিকৃত ছবি ও ভিডিও উদ্ধার করার পর ঘটনাটি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এদিকে সাইবার ক্রাইমের শিকার তরুণ-তরুণী ও গৃহবধূরা লোকলজ্জার ভয়ে এখন ঘরে অন্তরীণ। বন্ধ হয়ে গেছে অনেকের লেখাপড়া। কেউ কেউ লোকলজ্জার ভয়ে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। অপরদিকে এই অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের আটক ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে আন্দোলনমুখর হয়ে উঠেছে এলাকার অভিভাবক ও ক্ষতিগ্রস্তদের স্বজনরা। মিছিল-মিটিংয়ের পাশাপাশি চলছে মানববন্ধন আর বিক্ষোভ প্রদর্শন। এসব ঘটনায় থানা পুলিশ হলেও অজ্ঞাত কারণে এখনও জড়িতদের কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। যশোর শহর ও শহরতলীতে ব্যাঙের ছাতার মতো সাইবার ক্যাফে গড়ে উঠেছে। সামান্য পুঁজিতে এ ব্যবসা করা যায় বলে এর প্রসারতা দিন দিন বাড়ছে। ছোট্ট একটি ঘর, একটি কম্পিউটার বা ল্যাপটপ আর একটি ইন্টারনেটের লাইন থাকলেই এ ব্যবসা শুরু করা যায়। ফলে দিন দিন বেকার সমস্যার সমাধানে যুবকরা এই ব্যবসার প্রতি বেশি ঝুঁকছে। মোবাইলে গান ও রিন টোন লোড, সফটওয়্যার ডাউনলোড, বিকাশ, মোবাইল ফোনে ফ্লাক্সি লোডসহ নানা রকম ব্যবসা হচ্ছে এসব সাইবার ক্যাফেতে। এছাড়া কম্পিউটারে ছবি প্রিন্ট, কম্পিউটার ব্রাউজিংসহ হরেক রকমের কর্মকা- হচ্ছে এসব ছোট্ট দোকানগুলোতে। প্রয়োজনে মানুষ এসব প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের কাঙিক্ষত সেবা গ্রহণ করছে। কিন্তু সেই সেবা দিতে গিয়ে নানা রকম অপরাধমূলক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে কোন কোন সাইবার ক্যাফের মালিক বা ব্যবসায়ী। তারা বিশেষ করে সুন্দরী-তরুণীদের ছবিকে ফটোসপের মাধ্যমে বিকৃত করে যৌন উত্তেজক কোন ছবির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে বাজারে বিশেষ করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে টুইটার, ফেইসবুক ও ইউটিউবে ছেড়ে দিচ্ছে। ফলে ভুক্তভোগীরা সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছে। অনেকে আবার এসব কর্মকা-ের মাধ্যমে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ব্লাক মেইল করে নানা অসামাজিক কর্মকা-ে জড়াতে বাধ্য করছে। কেউ কেউ ওই প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে হচ্ছেন সর্বস্বান্ত। এ রকমই একটি সাইবার ক্রাইমের শিকার হয়েছে যশোর সদর উপজেলার সূতীঘাটা এলাকার একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও একটি দাখিল মাদরাসার কয়েক শ’ শিক্ষার্থী। লিখিত অভিযোগে সূতীঘাটা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির অভিভাবক সদস্য আবদুর রাজ্জাক উল্লেখ করেছেন, বালিয়াডাঙ্গার  আবদুল গফুরের ছেলে তমাল ইসলাম বুলবুল ও পান্তাপাড়া গ্রামের বাবর আলীর ছেলে জনি সূতীঘাটা বাজারের একটি ফটো স্টুডিও বুলবুল সাইবার ক্যাফের মালিক। সম্প্রতি এরাসহ আরও কয়েকজন বখাটে যুবক সূতীঘাটা মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও সূতীঘাটা দাখিল মাদরাসার ৩০০-৪০০ মেয়ের ছবি সংগ্রহ করে তা ফটোশপের মাধ্যমে বিকৃত করে বিভিন্ন ধরনের উত্তেজক ছবির সঙ্গে জোড়া লাগিয়ে নীল ছবি তৈরি করে। পরে তারা এসব ছবি ব্যবহার করে বেশ কিছু মেয়েকে ব্ল্যাক মেইল করে তাদের সর্বনাশ করে। এখানেই তাদের অপরাধ থেমে থাকেনি। স্টুডিও ব্যবসার কারণে এলাকার অনেক বউ-ঝিরা এ স্টুডিও থেকে ছবি তোলে। ওই চক্রটি ওই সব ছবিও বিকৃতির মাধ্যমে কাটপিস করে ব্লু ফিল্ম তৈরি করে তা ইন্টারনেটে, ফেইসবুকে, ইউটিউবে, টুইটারে ছেড়ে দিয়েছে সম্প্রতি এ রকম বেশ কিছু যৌন বিকৃত ছবি ও ভিডিও চিত্র এলাকার যুবকদের মোবাইলে দেখতে পান স্থানীয়রা। পরে বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে গেলে সব বেরিয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোটা এলাকায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। উত্তেজিত জনতা ওই স্টুডিওটি ভাঙচুর করে তাতে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। অভিযোগ পাওয়ার পর কোতোয়ালি পুলিশ স্টুডিও থেকে একটি ল্যাপটপ ও ২টি কম্পিউটার ও ক্যামেরাসহ বেশ কিছু নীল ছবির ব্লুপ্রিন্ট ও স্থানীয় স্কুল-মাদরাসার কয়েক শ’ ছাত্রীর বিকৃত ছবি উদ্ধার করে। ঘটনার পর থেকে বুলবুল ও জনি এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে। গতকাল দিনভর এসব বিষয় নিয়ে সরজমিন খোঁজখবর নিয়ে স্থানীয় অভিভাবক, স্কুল-মাদরাসার শিক্ষকবৃন্দ এবং ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এই ভয়াবহ ক্রাইম সম্পর্কে লোমহর্ষক সব তথ্য পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে ওই চক্রটি এলাকার স্কুল, কলেজ ও মাদরাসাগামী বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে এভাবে ব্ল্যাক মেইল করে তাদেরকে বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকা-ে লিপ্ত হতে বাধ্য করেছে। পরে তা ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়েছে। ওই চক্রের এহেন কর্মকা-ের শিকার বেশ কয়েকজন মেয়ের অভিভাবকরা বলেন, এসব কুরুচিপূর্ণ ছবি কম্পিউটারে ছেড়ে দেয়ার ফলে এখন আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ দেখাতে পারছি না। অনেকে বিশ্বাসও করছে। কেউ কেউ নানা রকম বাজে মন্তব্য করছে। ঘটনার পর থেকে গত ১ মাস ধরে সূতীঘাটা স্কুল ও মাদরাসায় মেয়েরা আসা-যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে প্রধান শিক্ষক জাকির হোসেন বলেন, ঘটনা তো সবই শুনেছেন। নতুন করে কি আর বলবো। বর্তমানে এখানে স্কুল চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। লোকলজ্জা আর সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে মেয়েরা স্কুলে আসতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে। বিষয়টি প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তিরা জানেন বলে তিনি দাবি করেন। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মাহামুদ হাসান লাইফ বলেন, ঘটনাটি জঘন্য। যে কোন হত্যাকা-ের তুলনায় এটি মারাত্মক অপরাধ। এই সাইবার ক্রাইমের মাধ্যমে স্কুল ও মাদরাসার ৩৫০ জন মেয়ের জীবন, মানসম্মান ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। এসব পরিবারের লোকজন সমাজে মুখ দেখাতে পারছেন না। অনেকে লোকলজ্জার ভয়ে এলাকা ছাড়তে শুরু করেছেন। তিনি জানান, এ ব্যাপারে আমরা আইনের আশ্রয় নিয়েছি। কোতোয়ালি থানায় একটি এজাহার দাখিল করা হয়েছে। ম্যানেজিং কমিটির সদস্য আবদুর রাজ্জাক বাদী হয়ে গত ১৩ই এপ্রিল কোতোয়ালি থানায় এই এজাহার দাখিল করেন। পুলিশ এজাহারটি আমলে নিয়ে তা তদন্তের জন্য এএসআই সাইদুল ইসলামকে দায়িত্ব দেন। ইতিমধ্যে পুলিশ বুলবুল স্টুডিও ও সাইবার ক্যাফেটি তল্লাশি চালিয়ে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, শতাধিক নীল ছবির ভিডিও ক্যাসেট, যৌন বিকৃত রঙিন ছবিসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি উদ্ধার করেছে। এ ঘটনায় জড়িতদের আটক ও শাস্তির দাবিতে স্থানীয় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা শুরু করেছেন আন্দোলন। এদিকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এএসআই সাইদুল ইসলাম জানান, লিখিত এজাহার পাওয়ার পর অভিযুক্তদের আটকের বিষয়ে তৎপরতা চলছে।
যেভাবে ঘটনার শুরু: বছর দুই আগে সূতীঘাটা বাজারে বুলবুল কম্পিউটার সেন্টার ও ফটো স্টুডিও নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলে বসে বুলবুল তমাল ও তার বন্ধু জনি। এই স্টুডিও থেকে স্থানীয় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে ৯ম শ্রেণীর রেজিস্ট্রেশন ও অন লাইনে ফরম ফিলআপের কাজ সম্পন্ন করতে থাকে। এছাড়া স্থানীয় বউ-ঝিরাও এই স্টুডিও থেকে প্রয়োজনে বা শখ করে তাদের ছবি তুলতে শুরু করে। এসব ছবির ডিজিটাল কপি সংরক্ষণের মাধ্যমে তা দিয়ে খারাপ মতলব আঁটতে থাকে জনি ও বুলবুল। প্রথম পর্যায়ে ২/১টি মেয়ের ছবি নিয়ে তারা খারাপ কাজে লাগানোর মাধ্যমে হাতে খড়ি নেয়। অভিযোগ রয়েছে, ছবি বিকৃতি বা খারাপ ভিডিও তৈরির মাধ্যমে তারা স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের বিপথগামী করতে শুরু করে। প্রথম পর্যায়ে নিজেরা এসব মেয়েকে ব্লাক মেইল করে ব্যবহার করলেও একপর্যায়ে তারা তা ব্যবসা হিসেবে নেয়। তারা স্থানীয় বউ-ঝিদের ছবিও বিকৃত করে তৈরি করে ব্লু ফিল্ম। তারপর তা বিভিন্ন ভিডিও পাইরেসির দোকানে বিক্রি করে মোটা অঙ্কের টাকা আয় করা শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি স্থানীয় হাইস্কুল ও মাদরাসার ছাত্রীদের ছবি বিকৃত করে একইভাবে নীল ছবির ভিডিওতে সংযুক্ত করে তা বাজারে ছেড়ে দেয়। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেইসবুক, ইউটিউব, টুইটারসহ বিভিন্ন ওয়েব সাইডে এসব কুরুচিপূর্ণ ছবি ছেড়ে দেয়। সম্প্রতি ইউটিউবের মাধ্যমে এরকম বেশ কয়েকটি যৌন উত্তেজক  ভিডিও চিত্র ও স্টিল ছবি হস্তগত হয় এলাকার যুবকদের। তারা এসব ছবি নিয়ে কানাঘোসা করতে থাকলে তা ছড়িয়ে পড়ে যুবকদের মোবাইলে মোবাইলে। ফলে একপর্যায়ে তা ফাঁস হয়ে পড়ে। শুরু হয় উৎস অনুসন্ধানের। বেশ কিছু দিন অনুসন্ধান করার পরই গত ১২ই এপ্রিল তা প্রকাশ পায়। স্থানীয় অভিভাবকরা বুলবুলের স্টুডিও অনুসন্ধান করে ঘটনার সত্যতা খুঁজে পান। তার পর থেকেই বুলবুল ও তার সহযোগী জনি লাপাত্তা।
এ ব্যাপারে হাইস্কুলের সাবেক এক সভাপতি  বলেন, যা ঘটেছে তা ভাষায় বলা সম্ভব নয়। আমার নিজের মেয়ে, ভাইজি ও ভাইপোদের ছবি নিয়ে ওই কুচক্রী মহল যে কিভাবে বিকৃত করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়েছে তা কোন পিতা হিসেবে মূলে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। মনে হচ্ছে ওই কুরুচিপূর্ণ ভিডিও দেখার আগে মৃত্যুই ভাল ছিল। তিনি বলেন, এই ঘটনার পর থেকে মেয়েরা স্কুলে আসছে না। অনেকে বাড়ি থেকে বের হতে পারছে না। রাস্তায় রাস্তায় ছেলেদের মোবাইলে এসব ভিডিও শোভা পাচ্ছে। কিভাবে মুখ দেখাবো বলুন। তিনি বলেন, তার মতো কয়েক শ’ অভিভাবকের অবস্থা একই রকম। অনেকে মানসম্মানের ভয়ে মেয়েকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু লাভ কি বলুন। ইন্টারনেট তো সব জায়গায় আছে। তিনি এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই ঘটনা ফাঁসের পর মানসম্মান রক্ষার্থে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছে। অনেকে বলছেন পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে তাতে করে এই এলাকায় বড় ধরনের অঘটন ঘটতে পারে। কারণ মা-বাবা ভাই-বোন সবার সামনে এই ঘটনার শিকার মেয়েরা মুখ তুলে তাকাতে পারছেন না।

শেয়ার করুন