রিজওয়ানার স্বামীকে ফিল্মিস্টাইলে অপহরণ

0
172
Print Friendly, PDF & Email

ম্যাগসাসে পুরস্কার বিজয়ী বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবুবকর সিদ্দিককে (৪৭) দিনদুপুরে ফিল্মি স্টাইলে অপহরণ করেছে দুষ্কৃতকারীরা। গতকাল বেলা সোয়া ৩টার দিকে নারায়ণগঞ্জ থেকে কাজ শেষে ঢাকায় ফেরার পথে ফতুল্লা এলাকায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডে ভূঁইয়া ফিলিং স্টেশনের সামনে থেকে তাকে অপহরণ করা হয়। তিনি নারায়ণগঞ্জের একটি রফতানিমুখী পোশাক কারখানার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। অফিস শেষে তিনি ঢাকার বাসায় ফিরছিলেন। ঘটনার পর এই বিষয়টি নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে রিজওয়ানা পরিবেশ নিয়ে আন্দোলন করায় এবং ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে অব্যাহত তৎপরতা চালানোয় তার স্বামীকে অপহরণ করা হতে পারে। ওই পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তাদের ব্যক্তিগত কোনো শত্রু নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেছেন, আবুবকর সিদ্দিককে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
কে বা কারা কী কারণে আবুবকর সিদ্দিককে অপহরণ করেছে এ ব্যাপারে পরিবারের কেউ কিছু জানাতে পারেননি। বিকেলে বেলার নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে যান। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, তার জানা মতে তার স্বামীর কোনো শত্রু নেই। তিনি বলেন, তাদের এমন কোনো অর্থবিত্তও নেই যে, কেউ মুক্তিপণের জন্য তাকে অপহরণ করবে। তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা, আমার পেশাগত কারণে ুব্ধ কোনো গোষ্ঠী আবুবকরকে অপহরণ করতে পারে।’
নারায়ণগঞ্জের এসপি সৈয়দ নুরুল ইসলাম জানান, অপহৃত আবুবকর সিদ্দিক ফতুল্লার হামিদ ফ্যাশনের ঊচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বুধবার বিকেল সোয়া ৩টায় তিনি তার ব্যক্তিগত গাড়িযোগে ঢাকা যাওয়ার পথে ভূঁইয়া ফিলিং স্টেশনের সামনে পৌঁছামাত্র একটি হাইএস মাক্রোবাস তার গাড়িটির গতি রোধ করে। পরে ওই গাড়ি থেকে ৭-৮ যুবক লাঠিসোঁটা ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে ভয় দেখিয়ে সিদ্দিককে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। তাকে উদ্ধারে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে বলে জানান এসপি।
গত রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অপহৃত আবুবকর সিদ্দিককে উদ্ধার করতে পারেনি পুুলিশ। এ বিষয়ে ফতুল্লা মডেল থানার ওসি আক্তার হোসেন জানান, তাকে উদ্ধারে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।
রিজওয়ানা হাসানের সহকর্মী বেলার আইটি কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন জানান, আবুবকর নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকার বাসায় ফিরছিলেন। মাঝপথে তাকে কৌশলে অপহরণ করা হয়। নীল রঙের একটি মাইক্রোবাস পিছু নিয়ে এসে ফতুল্লার জালকুড়ি ভূঁইয়া ফিলিং স্টেশনের সামনে আবুবকরের প্রাইভেটকারের পেছনে ধাক্কা দেয়। তখন কী তি হয়েছে দেখার জন্য তিনি ও চালক রিপন গাড়ি থেকে নামেন। এ সময় অপহরণকারীরা পিস্তল দিয়ে রিপনের মাথায় আঘাত করে এবং চোখে মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে দিয়ে আবুবকর সিদ্দিককে অস্ত্রের মুখে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে ঢাকার দিকে চলে যায়। গাড়িতে অপহরণকারী ৭-৮ জন ছিল।
আবুবকরের গাড়িচালক রিপন জানান, নীল রঙের মাইক্রোবাসে করে সাত-আটজন অস্ত্রধারী আবুবকর সিদ্দিককে অস্ত্রের মুখে নিয়ে যায়। ওই অস্ত্রধারীদের চুল ছোট ও পরনে টি-শার্ট ছিল। ‘আমাকে বাঁচান, আমাকে বাঁচান’ বলে আবুবকর চিৎকার করলেও অস্ত্রধারীদের ভয়ে কেউ সামনে এগোনোর সাহস করেনি।
রিপন সাংবাদিকদের জানান, ফতুল্লা পোস্ট অফিস রোডসংলগ্ন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পুরাতন সড়কের পাশে অবস্থিত হামিদ ফ্যাশনের অফিস থেকে দুপুর সোয়া ৩টায় নিজস্ব গাড়িতে (ঢাকা মেট্রো- গ- ১৫-৮৮০০) আবুবকর সিদ্দিককে নিয়ে তিনি ঢাকা যাচ্ছিলেন। গাড়িটি ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ভূঁইগড় দেলপাড়া ভূঁইয়া ফিলিং স্টেশনের সামনে পৌঁছার পর পেছন থেকে একটি হাইয়েস গাড়ি ধাক্কা দেয়। তখন রিপন গাড়ি থামানোর সাথে সাথে ওই গাড়ি থেকে ৭-৮ জন যুবক অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা নিয়ে নিচে নামে। রিপনকে অস্ত্র ঠেকিয়ে আবুবক্কর সিদ্দিককে টেনে মাইক্রোবাসে তুলে দ্রুত পালিয়ে যায়।
আবুবকর সিদ্দিকের অপহরণে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) গভীর উদ্বেগ ও তাকে দ্রুত উদ্ধারের জোর দাবি জানিয়েছে। বাপার সভাপতি এ এস এম শাহজাহান ও সাধারণ সম্পাদক ডা: মো: আব্দুল মতিন এক বিবৃতিতে বলেন, আমরা অত্যন্ত গভীর উদ্বেগের সাথে জানতে পেরেছি যে, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবুবকর সিদ্দিক ওরফে সিদ্দিকুর রহমান নারায়ণগঞ্জ থেকে অপহৃত হয়েছেন। আমরা এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও নিন্দা প্রকাশ করছি। বাপার নেতৃবৃন্দ আবুবকর সিদ্দিককে উদ্ধারে প্রশাসনিক শক্তি প্রয়োগে সব পরিবেশবাদীর পক্ষ থেকে সরকার ও প্রশাসনের প্রতি জোর দাবি জানান। তারা বলেন, ‘আমরা চাই তিনি সম্পূর্ণ সুস্থভাবে আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন।’
পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান দাবি করেছেন, তার পেশাগত কাজে প্তি হয়ে কেউ তার স্বামীকে অপহরণ করেছে। গতকাল স্বামী আবু বকর সিদ্দিক অপহৃত হওয়ার খবর পেয়েই নারায়ণগঞ্জে যান পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক। যেখান থেকে আবু বকর সিদ্দিককে অস্ত্রের মুখে তুলে নেয়া হয়, সেই স্থানে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন রিজওয়ানা। সেখানে পুলিশ কর্মকর্তারাও ছিলেন।
তিনি বলেন, আমার জানা মতে, তার (সিদ্দিক) কোনো শত্রু নেই। আমাদের এমন কোনো টাকা-পয়সাও নেই যে, কেউ অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করতে পারে। তিনি বলেন আমার পেশাগত কর্মকাণ্ডে বসুন্ধরা, মধুমতি, আশিয়ান, শিপ ব্রেকারসহ কিছু ব্যক্তি-গোষ্ঠী চরমভাবে ুব্ধ। তারাই হয়তো পরিকল্পিতভাবে আমার স্বামীকে অপহরণ করেছে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপারকে রিজওয়ানা বলেন, আপনারা যদি নারায়ণগঞ্জের টর্চার সেলগুলোতে অভিযান চালান, তাহলে হয়তো ওর খবর পাওয়া যেতে পারে। তখন পুলিশ সুপার বলেন, টর্চার সেলগুলো তো র‌্যাব অভিযান চালিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। এ সময় রিজওয়ানা কান্নায় ভেঙে পড়েন, বলেন আমি আমার স্বামীকে সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরত চাই। অপহরণস্থল থেকে রিজওয়ানা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মো: শহীদুল ইসলামের গাড়িতে চড়ে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে যান। সেখানে পৌঁছার পর তিনি পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার ও র‌্যাবের কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে টেলিফোন করে স্বামীকে উদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানান।
ম্যাগসেসে পুরস্কারজয়ী রিজওয়ানা পরিবেশ ধ্বংসের বিভিন্ন কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সক্রিয়, এই ধরনের অনেক মামলায় আইনি লড়াইও চালাচ্ছেন তিনি। সম্প্রতি ধানমন্ডি মাঠ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে আন্দোলনে নামেন রিজওয়ানা। এ নিয়ে মানববন্ধন করা হয়েছে। দুই দিন আগেও একটি টিভি চ্যানেলের টকশোতে রিজওয়ানা এই মাঠ নিয়ে কথা বলেছেন। প্রভাবশালীরা ওই মাঠটি তাদের কাজে ব্যবহার করে আসছে।
রিজওয়ানার স্বামী আবু বকর সিদ্দিকের বেড়ে ওঠা নারায়ণগঞ্জে। তিনি ফতুল্লা পোস্ট অফিস মোড়ের হামিদ ফ্যাশন লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক। ওই প্রতিষ্ঠানটির মালিক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। গত ফেব্রুয়ারি মাসে এই কারখানা পরিচালনার দায়িত্ব নেন আবু বকর সিদ্দিক। তার আগে নারায়ণগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীর প্রতিষ্ঠানে ছিলেন তিনি।
স্বামী অপহরণের ঘটনায় সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান একটি মামলা করেছেন বলে ফতুল্লা মডেল থানার ওসি আকতার হোসেন জানিয়েছেন।
এ দিকে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের অপহৃত স্বামী আবু বকর সিদ্দিককে দ্রুত খুঁজে বের করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এ ছাড়া এ ঘটনায় ১০ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম জানান, অপহৃত আবু বকরকে উদ্ধার এবং ঘটনার রহস্য উদঘাটনে জেলা পুলিশের প থেকে ১০ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) সাজ্জাদুর রহমান ও সদস্যসচিব অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শহীদুল ইসলাম।
এ ঘটনায় সন্ধ্যা ৭টার দিকে ফতুল্লা মডেল থানার ওসি আকতার হোসেন জানান, অপহরণের ঘটনায় সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বাদি হয়ে তার থানায় মামলা করেছেন।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, বিষয়টা জানার পরই আমি পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি), র‌্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) ও পুলিশের বিশেষ শাখার প্রধানকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছি। কেন এসব ঘটনা বাড়ছে, তা-ও তাদের কাছে জানতে চেয়েছি।

শেয়ার করুন