বিএনপি নেতাদের সময় কাটছে আদালত চত্বরে

0
172
Print Friendly, PDF & Email

মামলার জালে বন্দি হয়ে পড়েছে বিএনপি। এসব মামলা মোকাবেলা করতে গিয়ে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সময় দিতে পারছেন না বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা। দলীয় কর্মকাণ্ডের চেয়ে মামলা মোকাবেলায় আইনজীবীদের চেম্বারেই বেশি সময় দিতে হচ্ছে তাদের। প্রতিদিন সকালে যখন দলীয় কর্মকাণ্ডে নেতাদের ব্যস্ত থাকার কথা তখন দলের সিনিয়র নেতাসহ অনেককেই আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হচ্ছে। এসব মামলায় নীতিনির্ধারকসহ অনেক নেতা ধারাবাহিকভাবে কারাভোগ করছেন। ফলে বারবার ব্যাহত হচ্ছে সাংগঠনিক পুনর্গঠনের কাজ। সর্বশেষ স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিবউন নবী খান সোহেল কারাগারে যাওয়ায় স্থগিত হয়ে যায় মহানগর বিএনপির নতুন কমিটি ঘোষণা।
জানা গেছে, দলের চেয়ারপারসন থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় ৩০ হাজারের মতো মামলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ও অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ অনেক নেতার নামে অর্ধশতাধিক মামলাও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কেউ কেউ সেঞ্চুরিও করেছেন। যুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি বিএনপির নির্বাহী কমিটির বর্তমান সহ-ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর নামে সর্বাধিক ১১০টি করে মামলা রয়েছে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো মামলায় নেতাদের আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। দলীয়ভাবে গঠিত আইনি সহায়তা কেন্দ্রের আইনজীবীরাও বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের মামলা মোকাবেলা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। কবে কোন মামলার শুনানি, কোন মামলার জামিনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে তা নোট বুকে লিখে রাখতে হচ্ছে। এদিকে উচ্চ আদালতে আগাম জামিনের পথ সংকুচিত হওয়ায় বিএনপির নেতাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে আতংক। কারণ প্রতিদিনই দলের কোনো না কোনো নেতাকে আগাম জামিনের জন্য উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সদ্য কারামুক্ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, সরকার আন্দোলন দমানোর কৌশল হিসেবে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নামে হাজার হাজার মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। এসব মামলার কারণে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে মারাÍক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে। দলীয় কর্মকাণ্ড ফেলে নেতাকর্মীদের আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হচ্ছে। মামলা মোকাবেলায় ব্যস্ততার কারণে কোনো সাংগঠনিক কাজ করা যাচ্ছে না।
নেতাকর্মী ছাড়াও জিয়া পরিবারের নামেই আছে ২৭টি মামলা। এর মধ্যে সাতটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ও বাকিগুলো গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দায়ের করা। একটি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর ৬ বছরের সাজাও হয়েছে। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়েছে। বুধবার মামলা দুটির চার্জ গঠন বাতিল চেয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করা হয়েছে। একই সঙ্গে মামলা দুটির কার্যক্রম স্থগিত ও বিচারিক আদালতের নথি তলবের আরজি জানান খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। এ দুটি ছাড়াও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্যাটকো দুর্নীতি, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি দুর্নীতি ও নাইকো দুর্নীতির মামলা রয়েছে। খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মোট ১৪টি মামলা রয়েছে। মানি লন্ডারিং মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করা হয়। এছাড়া ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা-মামলাসহ চারটি মামলা বিচারাধীন। খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধে সাতটি ও তারেক রহমানের স্ত্রী জোবায়দা রহমানের বিরুদ্ধে একটি মামলা রয়েছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে এজাহারভুক্ত মামলা রয়েছে ১৯টি। এর মধ্যে ৬টি মামলায় চার্জশিটও দেয়া হয়েছে। বাসে অগ্নিকাণ্ডে উস্কানি দেয়া, বাংলামোটরে পুলিশ হত্যা মামলা, পরীবাগে বাসে পেট্রলবোমা ছুড়ে মানুষ হত্যা ও নাশকতার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় প্রায় এক মাস জেল খেটে ৯ এপ্রিল মঙ্গলবার জামিনে বের হন তিনি। এর আগেও তিনি আরও তিনবার গ্রেফতার হন। একবার এক রাত ডিবি কার্যালয়ে থাকার পর তাকে ছেড়ে দেয়া হলেও দু’বার কারাভোগ করেন।
দলের অন্যতম নেতা স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন মানি লন্ডারিংয়ের এক মামলায় বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। এছাড়া গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর, পুলিশের কাজে বাধা দেয়াসহ ১২টি মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার বিরুদ্ধে মোট মামলা রয়েছে ২৩টি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে গ্রেফতার হয়ে কয়েক মাস কারাভোগ শেষে জানুয়ারির মাঝামাঝি মুক্তি পান তিনি। স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে মোট মামলা ৪৬টি। সর্বশেষ ১৬ মার্চ কয়েকটি মামলায় নিু আদালতে মির্জা ফখরুলসহ হাজিরা দিতে যান তিনি। কিন্তু আদালত তাদের জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। বেশ কয়েকদিন কারাভোগ শেষে ৩ এপ্রিল জামিনে মুক্তি পান মির্জা আব্বাস। স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের নামেও রয়েছে ১০টি মামলা। সচিবালয়ে বোমা হামলার হামলায় বছরখানেক আগে জেলও খাটেন তিনি।
মামলার কারণে দলীয় কর্মকাণ্ড বিঘ্নিত হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় যুগান্তরকে বলেন, দলীয় কর্মকাণ্ড তো পরের বিষয়; মামলার কারণে ব্যক্তিগত জীবনেও নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। নিয়মিত আদালতে হাজিরা দেয়ায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পারিবারিক অনেক কাজ করা সম্ভব হয় না।
জাতীয় নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার নামে ১৩টি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় ৪ ডিসেম্বর উত্তরার একটি বাড়ি থেকে গ্রেফতার হন তিনি। প্রায় আড়াই মাস কারাভোগের পর ১৯ ফ্রেব্র“য়ারি জামিনে মুক্তি পান তিনি। বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর নামে রয়েছে ৮টি মামলা। সর্বশেষ গত বছরের ৩০ নভেম্বর রুহুল কবির রিজভী গ্রেফতার হওয়ার পর দলের দাফতরিক কর্মকাণ্ড পুরো থমকে যায়। বিএনপির সিনিয়র কয়েকজন নেতাকে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে দাফতরিক কাজ করতে খালেদা জিয়া নির্দেশ দিলেও কেউ তা শোনেননি। দুই মাসের বেশি সময় কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছিল অবরুদ্ধ। দলীয় নেতাকর্মীদের কোনো পদচারণা সেখানে ছিল না।
বিএনপির স্বনির্ভরবিষয়ক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর নামে ৪০টি মামলা রয়েছে। নাটোরে যুবলীগ নেতা হত্যা মামলায় এক বছরের বেশি সময় কারাভোগ করে সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পান তিনি। সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহসানুল হক মিলনের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ৩৪টি। মানি ব্যাগ চুরি থেকে শুরু করে বৃদ্ধাকে ধর্ষণের মামলাও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
অঙ্গসংগঠনের মধ্যে যুবদলের সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের নামে রয়েছে ১১০টি মামলা। এরমধ্যে ১৯টি মামলায় চার্জশিটও দেয়া হয়েছে। আলাল যুগান্তরকে বলেন, সংগঠনের চেয়ে এসব মামলা মোকাবেলায় বেশি তৎপর থাকতে হয়। কারণ দলীয় বা ব্যক্তিগত কাজ করতে গিয়ে কোনো কারণে মামলায় হাজিরা দেয়া না হলে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আশংকা রয়েছে। গড়ে প্রতিদিন তার ছয়টি মামলা মোকাবেলা করতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।
যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম নীরবের নামেও রয়েছে শতাধিক মামলা। ৫৩টি মামলায় এখনও তিনি আগাম জামিনই পাননি। তাই গ্রেফতার এড়িয়ে চলার কারণে দলীয় কর্মকাণ্ডে সময় দিতে পারছেন না। স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিবউন নবী খান সোহেলের নামে মামলা ২৩টি। সর্বশেষ ১১ মামলায় নিু আদালতে হাজিরা দিতে গেলে তার জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠান আদালত। স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপুর নামে ও সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল বারী বাবুর নামে রয়েছে ২২টি করে মামলা। ছাত্রদলের সভাপতি আবদুল কাদের ভুঁইয়া জুয়েলের নামে ৪৭টি ও সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিবের নামে ৯৫টি মামলা রয়েছে। ছাত্রদলের শীর্ষ এই দুই নেতা প্রায় পাঁচ মাস ধরে কারাগারে রয়েছেন। ফলে সংগঠনের কার্যক্রমে নেমে এসেছে স্থবিরতা। ছাত্রদলের বিভিন্ন ইউনিটের পুনর্গঠনের কাজও থমকে আছে। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে কারাগারে রেখে সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর কোনো উদ্যোগ নেই বিএনপির হাইকমান্ডের।
এছাড়া মামলার জাল থেকে রক্ষা পাননি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, হান্নান শাহ, যুগ্ম-মহাসচিব আমান উল্লাহ আমান, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, সালাউদ্দিন আহমেদ, আবদুস সালামসহ আরও অনেকেই। এদের অনেকেই এসব মামলায় কারাভোগও করেন।
মামলা মোকাবেলা করতে গিয়ে সুষ্ঠুভাবে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালানো যাচ্ছে না মন্তব্য করে স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল বারী বাবু বলেন, মাসে অন্তত ২০ দিন হাজিরা দিতে আদালতে যেতে হয়। তাই, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বে¡ও সাংগঠনিক সফরে ঢাকার বাইরে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আর ব্যক্তিগত স্বাদ-আহ্লাদ করার কথা তো মাথায়ই আসে না। এর মধ্যেও যতটুকু পারি সময় বের করে সাংগঠনিক কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানান এই নেতা।

শেয়ার করুন