চিকিৎসকদের ধর্মঘটে অচল বারডেম : রোগীদের দুর্ভোগ

0
133
Print Friendly, PDF & Email

বারডেমে রোগীদের জিম্মি করে ধর্মঘট পালন করছেন চিকিৎসকরা। তারা সকল কাজ বন্ধ করে  শাহবাগে নেমে আসে এবং রাস্তা আটকিয়ে সমাবেশ করে। এতে করে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় রোগীদের। উল্লেখ্য, চিকিৎসকদের ভুলে একজন রোগীর মৃত্যু হলে ওই রোগীর পরিবারের সদস্যদের হাতে কর্তব্যরত চিকিৎসককে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই ধর্মঘট ডাকা হয়। তবে মৃত রোগীর পরিবারের সদস্যরা কর্তব্যরত ডাক্তারকে লাঞ্ছিত করার কথা অস্বীকার করেছেন। আর স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, এই ঘটনায় দায়ীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা হবে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ধর্মঘটরত চিকিৎসকদের সাথে দিনভর বৈঠক শেষে বারডেম কর্তৃপক্ষ জানায়, আজকের মধ্যে হাসপাতালটির স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসবে।
সূত্র মতে, চিকিৎসকদের ধর্মঘটে সকাল থেকেই অচল হয়ে পড়ে রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত হাসপাতাল বারডেম। এতে ব্যহত হয় হাসপাতালের স্বাভাবিক চিকিৎসা সেবা। আর সেবা না পেয়ে দুর্ভোগের শিকার হয়ে বেরিয়ে গেছেন অসংখ্য রোগী। হাসপাতালে নতুন করে কেউ ভর্তি হতে যেমন পারেননি; তেমনি অনেকে রোগীকে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। এমনকি গতকাল মঙ্গলবার বারডেম হাসপাতালের চিকিৎসকরা রোগীদের হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতে পরামর্শ দিয়েছেন বলেও অভিযোগ করেছেন অভিভাবকরা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আসা ৮১২ নম্বর বেডের রোগী মমিন আলী প্রধানের ছেলে জিয়াউর রহমান গতকাল দুপুর সোয়া ২টায় এ প্রতিবেদককে বলেন, কোন চিকিৎসক রোগী দেখছেন না। সকালে পরীক্ষা করানোর কথা ছিল, টাকাও আগে জমা দেয়া হয়েছে। অথচ কেউ রোগীর বিভিন্ন টেস্টের নমুনাও নিচ্ছেন না। বরং সকালে বলা হয়েছে, আপনারা চলে যান। এখানে চিকিৎসা বন্ধ থাকবে। নার্স, ডাক্তার যারা এসেছিলেন দুপুরের মধ্যেই তারা ফিরে গেছেন।
তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীদের এরকম অভিযোগ অস্বীকার করেছে। হাসপাতালের মহা-পরিচালক প্রফেসর ডা. নাজমুন নাহার বলেন, ভর্তি নেয়া হচ্ছে না বা বহির্বিভাগে রোগী দেখা হচ্ছে না-এটা ঠিক। চিকিৎসকদের আন্দোলনের জন্য এসব কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে। তবে ভর্তি রোগীর কোন অবহেলা হচ্ছে না। বা কাউকে চলে যেতেও বলা হচ্ছে না। নিয়মিত ছাড়পত্র নিয়ে কেউ কেউ যাচ্ছেন। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। রোগীদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে হাসপাতালের মহা-পরিচালক জানিয়েছেন, আশা করছি আগামীকালের (আজ) মধ্যে হাসপাতালের এই অচলাবস্থার নিরসন হবে। হাসপাতালে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসবে। তিনি বলেন, গত ১৩ তারিখে রাতে যে ঘটনা ঘটেছে সেটা অনাকাক্সিক্ষত। পুলিশ পরিচয়ে ভিতরে ঢুকে পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এর জন্য দায়ি ঢাকা জেলার এএসপি মাসুদ ও সাবেক এক মন্ত্রীর এপিএস বাবু।
এদিকে সরেজমিনে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বারডেমে অবস্থান করে দেখা যায়, ডাক্তারদের ধর্মঘটের কারণে সেখানে রোগীদের দুর্ভোগের চিত্র। সেবা না পেয়ে রোগীরা ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। মারমুখিও হয়েছেন কেউ কেউ। কান্নায়ও ভেঙে পড়েছেন অনেকে। অনেকে আবার হাসপাতালের অভ্যার্থনা কক্ষে ঘুমিয়ে আছেন চিকিৎসার আশায়। এছাাড়াও রোগীর নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অনেক অভিভাবক কোন প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে রোগীদের নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেছেন। এরকম কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের।
জানা যায়, চিকিৎসককে মারধর ও হাসপাতাল ভাঙচুরের প্রতিবাদে গতকাল সকাল থেকে ৩ দিনের কর্মবিরতি শুরু করেন তারা। গত ১৩ই এপ্রিল রাত ৮টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান জাতীয় প্রেসক্লাবের কর্মচারী ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি সিরাজুল ইসলাম। অভিযোগ, তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ওইদিন রাতেই কর্তব্যরত ডা. আনোয়ার হোসেন, ডা. কল্যাণ দেবনাথ ও ডা. শামীমা আক্তারসহ ৪ চিকিৎসককে মারধর ও লাঞ্ছিত করেন মৃত ব্যক্তির স্বজনরা। এতে ওই চিকিৎসকরা গুরুতর আহত হন। এদের মধ্যে একজন নারী চিকিৎসকও রয়েছেন। এসময় ভাঙচুর করা হয় হাসপাতাল কক্ষ।
চিকিৎসকদের দাবি, এ হামলার ঘটনায় উপস্থিতি ছিলেন পুলিশের কর্মকর্তা এসি মাসুদ ও প্রাক্তন এক মন্ত্রীর এপিএস পরিচয়দানকারী বাবু। তারা হামলায় ইন্ধন যোগান। তাদের সরাসরি সহযোগিতার কারণে চিকিৎসকদের উপর হামলা চালিয়েছেন মৃত রোগীর স্বজনরা। তাদের রক্ষায় এগিয়ে এলে সহকারী অধ্যাপক ডা. ফিরোজ আমিন এগিয়ে এলে তাকেও লাঞ্চিত করা হয়। এর প্রতিবাদেই তারা কর্মবিরতি পালন করছেন। ঘটনার পরদিন ১৪ এপ্রিল ছুটি থাকায় মঙ্গলবার কর্মদিবসের শুরু থেকে আন্দোলনে নামেন চিকিৎসকরা।
কর্মসূচি চলাকালে সকালে তারা রাস্তায় নেমে আসেন। মানববন্ধন করে দোষী পুলিশ অফিসার ও অন্যদের শাস্তি দাবি করেন। তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন বিএমএ ও সরকার সমর্থিত চিকিৎসক সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ-স্বাচীপের মহাসচিব প্রফেসর ডা. এম. ইকবাল আর্সলান। আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের সব ক্ষোভ পুলিশ অফিসারের উপর। তার আশকারায় হামলা চালানো হয়েছে বলে দাবি করা হয়। মানববন্ধনে বলা হয় চিকিৎসকদের নিরাপত্তা না থাকলে সেবা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়বে। জানানো হয়, আজ ১০টা পর্যন্ত সেবা বন্ধ থাকবে। এসময় সংবাদ সম্মেলন করে পরবর্তি কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
হাসপাতালের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আমারও মানুষ। কিন্তু আমাদের উপর যেভাবে হামলা হল তা সভ্য সমাজে হতে পারে না। এটা দুঃখজনক। আমরা ৩ দিনের কর্মসূচি দিয়েছি। তবে কাল (আজ) এনিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। আমরা চাই না রোগীরা কষ্ট পান, তাদের সেবা ব্যহত হোক। তাই নতুন রোগী ভর্তি নেয়া হচ্ছে না। দেখাও হচ্ছে না। যারা ভর্তি আছেন তাদের সেবা দিচ্ছি। রুটিন কাজ বন্ধ রয়েছে।
সকাল থেকে ৬০০ বেডের এই হাসপাতালে অনেক রোগী ভর্তি হতে এসে ফিরে গেছেন। সাড়ে ৭টা থেকে সাড়ে ৮ টা পর্যন্ত সীমিত আকারে ডায়াবেটিস রোগীদের সেবা দেয়া হয়। এরপর থেকে সেবা বন্ধ হয়ে যায়। এতে রোগীরা চরম ভোগান্তি ও দুর্ভোগে পড়েন। ৯ এপ্রিল ভর্তি হওয়া ঢাকার রোগী নাহিদা রহমান ২টা ১৫ মিনিটে হাসপাতাল ছেড়ে যান। সেবা না পাওয়ায় তিনি অন্য হাসপাতালে ভর্তির জন্য ছাড়পত্র নেন। এতে চিকিৎসক নার্সরা উৎসাহিত করেছেন বলে দাবি তার মেয়ের।
ঢাকার গ্যান্ডারিয়ার থেকে আসা মোঃ মঞ্জুরের অপারেশনের তারিখ ছিল গতকাল সন্ধ্যা ৫টায়। কথা মতো না খেয়ে খালি পেটে এসেছেনও সকালে। ভর্তি হতে গেলে জানানো হয় বিকালের মধ্যে ভর্তি সম্ভব নয়। খালি পেটে অপেক্ষা করতে। দুপুর সাড়ে ১১টায় তিনি জানান, এখন অপারেশনের পর্যন্ত কোন নিশ্চিয়তা দিতে পারছে না ভর্তি বিভাগ। তিনি নির্দিষ্ট চিকিৎসকের রুমে গেলে রুমটি তালাবদ্ধ দেখেন। অন্য এক চিকিৎসক তাকে আজ চলে যেতে পরমার্শ দেন।
সিকান্দার আলী (৫৫) নামের অপর এক রোগী দিনাজপুর থেকে এসেছিলেন সকালে। ভর্তি হতে এসে পড়েন বেকায়দায়। বলেন, রোগীদের জিম্মি করে তারা আন্দোলন করছেন। আল্টিমেটাম দিয়ে কর্মসূচি পালন করতে পারতেন। তা না করে পুরো চিকিৎসা সেবাকে বন্ধ করে আমাদের দুর্গতিতে ফেলেছেন। ঢাকায় আমার কেউ নেই। এখন আমি যাবো কোথায়?
এদিকে গতকাল দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে ভুল চিকিৎসায় সিরাজুল ইসলামের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেন তার পরিবারের সদস্যরা। মেয়ে ফারহানা নাসরিন বলেন, ৯ এপ্রিল বাবাকে বারডেমে ভর্তি করাই। ১৩ এপ্রিল বিকেল ৪টার দিকে শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তাকে একটি অক্সিজেন নল দেয়া হয়। কিন্তু রোগীর কি অবস্থা তা তারা আমাদের জানাননি। সন্ধ্যার পর আরও অবনতি হয়। তারপর আইসিইউতে নিয়ে যাওয়ার পর তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। শুরুতেই তাকে আইসিইউতে নেয়া হয়নি। এটা ছিল তাদের ভুল ও অবেহলা। বাবার মৃত্যুর জন্য ডাক্তাররাই দায়ি। তিনি বলেন, সকালে আমরা জানতে পারলাম, আমরা নাকি হাসাতাল ভাঙচুর ও চিকিৎসকদের মারধর করেছি। তা একদমই সত্য নয়।
অপরদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বারডেমের ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে শাস্তির আওতায় আনার অনুরোধ করেছেন স্বরাষ্ট প্রতিমন্ত্রীকে।  সম্প্রতি বারডেমসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসকদের উপর হামলা ও হাসপাতালে ভাঙচুরের ঘটনায় গতকাল বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. মাহামুদ হাসান এবং মহাসচিব অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলানের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসলে মন্ত্রী তাৎক্ষণাৎ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে ফোন করে দোষী ব্যক্তিদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে শাস্তির আওতায় আনার অনুরোধ করেন।
সাক্ষাৎকালে বিএমএ নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সহানুভূতির সাথে তা বিবেচনা করে পরিস্থিতি উত্তরণে পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস দেন। এসময় তিনি চিকিৎসক ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষার জন্য এবং রোগীদের সুরক্ষার জন্য দুটো পৃথক আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান।
উল্লেখ্য, গত মাসে রাজশাহীতে চিকিৎসায় অবহেলায় রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় এক স্বাচিপ নেতাকে পুলিশ আটক করলে রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে ধর্মঘট ডাকে চিকিৎসকরা। এতে দেশের স্বাস্থ্যসেবা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। একই মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিসএমএমইউ) ডেন্টাল অনুষদে ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে দু’গ্রুপের দ্বন্দের জের ধরে ৪ দিনের ধর্মঘট পালন করা হয়। ফলে এ সময়েও রোগীরা চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হন।

শেয়ার করুন