২৪ এপ্রিল ঘিরে চাপের মুখে পোশাক শিল্প

0
144
Print Friendly, PDF & Email

আগামী ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের বর্ষপূর্তি সামনে রেখে দেশী-বিদেশী নানান চাপের মুখে পড়েছে দেশের তৈরী পোশাক শিল্প। ওই ঘটনায় হতাহতদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং শ্রমিকদের জন্য কাজের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে চাপ বাড়িয়ে চলেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, বিভিন্ন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এবং দেশী-বিদেশী এনজিওগুলো। তার ওপর ঘোষিত-অঘোষিত নানা শর্তের বেড়াজালে জড়িয়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে স্থগিত হয়ে যাওয়া বাংলাদেশী পণ্যের জিএসপি সুবিধা। শ্রমিকদের মজুরি ৭৯ শতাংশ বাড়লেও মোটেই বাড়েনি তাদের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য। সব মিলিয়ে রফতানি বাণিজ্যে ৮০ শতাংশ অবদান রক্ষাকারী এবং ৩৫ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী এ শিল্পের উদ্যোক্তারা এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন। আয়-ব্যয়ের সাথে তাল মেলাতে ব্যর্থ হয়ে গত এক বছরে বন্ধ হয়ে গেছে ছোট পুঁজির পাঁচ শতাধিক কারখানা।
গত বছরের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় এক হাজার ১৩৪ জন শ্রমিকের প্রাণহানির খবরে কেঁপে ওঠে সারা বিশ্ব। তারও আগে তাজরিন ফ্যাশন এবং গরীব অ্যান্ড গরীবসহ একাধিক কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তৈরী পোশাক রফতানিতে বিশ্ববাজারে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের শ্রমপরিবেশ নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়। ফলস্বরূপ গত বছরের ২৭ জুন স্থগিত হয়ে যায় দীর্ঘ দিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চলমান বাংলাদেশী পণ্যের অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা (জিএসপি)। গত ডিসেম্বর থেকে ৭৯ শতাংশ বাড়িয়ে শ্রমিকদের তিন হাজার থেকে এক লাফে পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি পরিশোধে বাধ্য হন উদ্যোক্তারা। অথচ এসব শ্রমিকের হাতে উৎপাদিত পণ্যের দাম এক টাকাও বাড়ায়নি আন্তর্জাতিক ক্রেতারা। উপরন্তু জিএসপি স্থগিত হয়ে  যাওয়ায় কেবল আমেরিকায় কমেছে ৩৫ লাখ ডলারের পোশাক রফতানি।
গত চার মাসে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক কারখানায় প্রবৃদ্ধির ধারা গত ১৫ বছরে সর্বনিম্ন দাবি করে বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, এক দিকে ক্রেতারা দাম বাড়াতে চাচ্ছে না বরং অর্ডার কমিয়ে দিচ্ছে।  যে ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এক লাখ পিস শার্ট নিতো তারা অর্ডার দিচ্ছে তার অর্ধেক। অন্য দিকে রয়েছে বাড়তি মজুরির চাপ। পোশাক কারখানার মালিকদের এখন এই দুই দিকের চাপ সামাল দিতে হচ্ছে। আগে যে কোম্পানি শতকরা দুই থেকে আড়াই শতাংশ লাভ করত তাকে এখন সমহারে লোকসান গুনতে হচ্ছে। এসব কারণে পোশাক উৎপাদন ও রফতানির সাথে সংশ্লিষ্ট কয়েক লাখ ব্যবসায়ীর জীবনে নেমে এসেছে অনিশ্চয়তা। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক কারখানা।
এ দিকে স্থগিত হওয়া জিএসপি আবার চালু করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া ১৬টি শর্ত পূরণের বিষয়ে গতকাল অগ্রগতি প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। সরকার ইতোমধ্যে অধিকাংশ শর্ত পূরণ করেছে জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ইপিজেডগুলোয় শ্রমিক ইউনিয়ন চালু এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক কারখানা পরিদর্শক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি শর্তগুলোও পূরণের চেষ্টা চলছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। যদিও সরকারের এই প্রতিবেদন যুক্তরাষ্ট্র সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করবে বলে মনে করতে পারছেন না বিশ্লেষকেরা। তাদের মতে, ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কের সাম্প্রতিক টানাপোড়েনে বাড়তি কোনো শুল্ক সুবিধা পাওয়া তো দূরের কথা, অদূর ভবিষ্যতে প্রতিযোগিতা করে পণ্য রফতানির সুযোগও হারাতে পারে বাংলাদেশ। উন্নয়নশীল বিশ্বের একমাত্র দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জিএসপি স্থগিত করে তারই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। নতুন চিন্তা অনুযায়ী, যেসব এইচএস কোডের পোশাক বাংলাদেশ থেকে বেশি সংখ্যায় আমেরিকায় রফতানি হয় সেগুলোর সংখ্যা নির্ধারণ করে দেয়া হবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
শ্রমিক নিরাপত্তা, শ্রমিকদের কর্মপরিবেশের কমপ্লায়েন্স সংক্রান্ত যেসব ইস্যুতে আমেরিকা জিএসপি স্থগিত করেছে বলে প্রচার মাধ্যমে বলা হচ্ছে এর কোনোটিকেই প্রকৃত কারণ মনে করতে রাজি নন সাধারণ মানুষ। বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের মতে এসব নিছকই অজুহাত। মূলত বাংলাদেশ সরকারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক যোগাযোগের দূরত্ব এবং আমাদের পক্ষ থেকে চীন, ভারত, তুরস্কের মতো লবিস্ট ফার্ম নিযুক্ত না থাকায় জিএসপি স্থগিত হয়েছে বলে মনে করছেন তারা। টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরের পাশাপাশি এ দেশে আমেরিকার পরম বন্ধু ড. ইউনূসের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হলে যুক্তিরাষ্ট্রের জিএসপি আবার পাওয়া যাবে বলেও আশাবাদ সাধারণ মানুষের। ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে পুরো জাতির পক্ষ থেকে একযোগে প্রচেষ্টা চালানো হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অপরাপর দেশে জিএসপি বাতিলের যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে তা-ও বন্ধ করা সম্ভব বলে মনে করছেন তারা।
বাংলাদেশ তৈরী পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী (পারভেজ) নয়া দিগন্তকে বলেন, আমেরিকায় যেকোনো বিল পাস হওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সম্পর্ক ও লবিস্ট ফার্মের কর্মতৎপরতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ সরকারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নানা কারণে ভালো না যাওয়া এবং সরকারিভাবে আমাদের কোনো লবিস্ট ফার্ম না থাকাকে জিএসপি স্থগিতের সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, মূলত বাংলাদেশ সরকারের সাথে রাজনৈতিক যোগাযোগের দূরত্ব এবং আমাদের পক্ষ থেকে চীন, ভারত, তুরস্কের মতো লবিস্ট ফার্ম নিযুক্ত না থাকায় এসব সমস্যা হয়েছে। কাজেই হারানো জিএসপি ফিরে পাওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বেঁধে দেয়া ১৬টি শর্ত পূরণের পাশাপাশি রাজনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের পরামর্শ দেন তিনি।

শেয়ার করুন