তৃণমূল সম্মেলনের গরজ নেই আওয়ামী লীগে। পদ ছাড়ছেন না জেলা নেতারা। এতে নতুন নেতৃত্ব যেমন মুখ থুবড়ে পড়েছে, তেমনি সাংগঠনিক অবস্থাও স্থবির। দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর পর পর সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও এমনও জেলা রয়েছে ১৮ বছর হয়ে গেলেও সম্মেলনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলই এর প্রধান কারণ হিসেবে মনে করছেন দলটির নেতারা। কেন্দ্র থেকে বারবার উদ্যোগ নেওয়ার পর সম্মেলন করাতে ব্যর্থ দায়িত্বপ্রাপ্তরা। টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে জুনের আগে তৃণমূল সম্মেলন সম্পন্নে দলের সভানেত্রীর নির্দেশনা থাকলেও কেন্দ্রীয় কমিটি এখন প্রস্তুত নয় বলে জানিয়েছেন দলের একাধিক নেতা। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে জেলা সম্মেলন শুরুর করার মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি দলে। আপাতত জেলা সম্মেলন শুরু করা যাচ্ছে না।
যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, জেলা সম্মেলন নিয়ে দলের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়নি। আগামীতে বেশ কয়েকটি দিবসভিত্তিক কর্মসূচি আছে সেগুলো শেষ হোক তারপর তৃণমূল সম্মেলনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। দলের উচ্চ পর্যায় সূত্রে জানা যায়, জেলা কমিটিতে যারা পদ পেয়েছেন তারা আর তা ছাড়তে চান না। সম্মেলন হলে নতুন নেতৃত্ব আসবে। এতে নেতৃত্ব এবং প্রভাব দুটোই হারাতে হবে। তাই পদ ধরে রাখতে মরিয়া তারা। আওয়ামী লীগের ৭৩টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে মাত্র ১৪টিতে কাউন্সিল হয়েছে। প্রায় ৫০০টি উপজেলা ও থানা কমিটির মধ্যে শদুয়েক কমিটির কাউন্সিল করা হয়েছে। অন্তত ২০ জেলায় এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। ১৫ জেলা কমিটি সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদক পদে ভারপ্রাপ্তদের দিয়ে চালানো হচ্ছে। তিনটি জেলায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দুটি পদেই আছেন ভারপ্রাপ্ত। আটটি জেলায় কাউন্সিল হয় না ১৬ বছর ধরে। সাত বিভাগের মধ্যে শুধু রংপুর ও চট্টগ্রামে কয়েকটি জেলায় সম্মেলন হয়েছে। এর বাইরে বরিশাল জেলা ও মহানগরের সম্মেলন হয়েছে। বিগত পাঁচ বছরে সম্মেলন হয়েছে রংপুর বিভাগের রংপুর জেলা, মহানগর, নীলফামারী, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রামের। চট্টগ্রাম বিভাগের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম উত্তর ও ফেনী জেলায়। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের শুধু সম্মেলনই হয়েছে নেতৃত্বে পরিবর্তন আসেনি। ফলে থামেনি কোন্দল। রাজধানীর পাশে নারায়ণগঞ্জ জেলাকে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় হৃৎপিণ্ড বলা হতো। কিন্তু সেখানেই কোনো কমিটিই নেই। ১৯৯৭ সালের ২০ ডিসেম্বর অধ্যাপিকা নাজমা রহমান সভাপতি ও শামীম ওসমান সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। এরপর ২০০২ সালের ২৭ মার্চ নারায়ণগঞ্জ-৫ (সদর-বন্দর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এস এম আকরামকে আহ্বায়ক করে কেন্দ্র থেকে ৬১ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি করে দেওয়া হয়। দলের আহ্বায়ক এস এম আকরাম পদত্যাগ করে যুক্ত হয়ে পড়েছেন নাগরিক ঐক্যের সঙ্গে। যুগ্ম-আহ্বায়ক মফিজুল ইসলাম মারা গেছেন দুই মাস আগে। এখন আহ্বায়ক কে তাও কেউ জানেন না। ময়মনসিংহ জেলার সম্মেলন হয়েছে ২০০৪ সালে। কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয় ২০০৫ সালে। অধ্যক্ষ মতিউর রহমান সভাপতি ও মতিন সরকারকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি গঠন করা হয়। দীর্ঘদিন সম্মেলন না হওয়ায় ঝিমিয়ে পড়েছে জেলার নেতৃত্ব। সভাপতি-সম্পাদকের কারণেই সম্মেলন করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে সাধারণ সম্পাদক মতিন সরকার বলেন, কেন্দ্র থেকে বলা হলেই আমরা সম্মেলনের জন্য প্রস্তুতি নেব। নেত্রকোনা জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়েছে ২০০৪ সালে। দীর্ঘদিন সম্মেলনের উদ্যোগ না নেওয়ায় অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকট আকার ধারণ করছে। এখানে পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে জেলার রাজনীতি। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের কারণে সম্মেলন করা যায়নি। তবে জেলা দফতর সম্পাদক মাজাহারুল ইসলাম বলেন, কেন্দ্র থেকে উদ্যোগ না নেওয়ায় সম্মেলন করা যায়নি। শেরপুর জেলার সম্মেলন করা হয় ২০০৩ সালে। তারপর কেন্দ্র থেকে যেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, তেমন পদ ছাড়তে চান না জেলার নেতারা। এ ছাড়া জেলার সভাপতি আতিউর রহমান আতিক ও সাধারণ সম্পাদক চন্দনকুমারের কারণেই ঠেকে আছে জেলার সম্মেলন বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় নেতারা। তারা বলছেন, দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী ও জেলা সভাপতি আতিকের কারণেই নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে ঝিমিয়ে পড়েছে জেলার রাজনীতি। এ বিষয়ে আতিউর রহমান আতিকের সঙ্গে গতকাল যোগাযোগ করা হলে তিনি সংসদে আছেন, এখন এ বিষয়ে কথা বলতে পারবেন না বলে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান। উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার সিরাজগঞ্জে ২০০৫ সালে সম্মেলনের মাধ্যমে জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনের পর জেলা সভাপতি এমপি আবদুল লতিফ মির্জার মৃত্যু হয়। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমানের দুর্বলতার সুযোগে সাধারণ সম্পাদক এ কে এম হোসেন আলী হাসান একক কর্তৃত্বে দল পরিচালনা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে নতুন নেতৃত্বও সৃষ্টি হয়নি। পুরনোদের প্রতি আস্থা নেই নতুনদের। পদ হারানোর ভয়েই সম্মেলনের উদ্যোগও নেওয়া হয় না বলে জানিয়েছেন জেলার নেতারা। তবে সাধারণ সম্পাদক এ কে এম হোসেন আলী হাসান বলেন, এ অভিযোগ মিথ্যা। জেলার তিনটি থানার সম্মেলন এখনো বাকি। সেগুলোর সম্মেলন হলেই জেলার সম্মেলন করা হবে। ২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি খুলনা মহানগর ও ১৬ জানুয়ারি জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক তৎপরতা কিছুটা থাকলেও জেলা আওয়ামী লীগের কোনো সাংগঠনিক তৎপরতা একেবারে নেই বললেই চলে। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড ঝিমিয়ে পড়ার পেছনে জেলা সভাপতি শেখ হারুন অর রশিদ ও সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা রশীদ সুজার মধ্যে গ্রুপিং একটি বড় কারণ বলে জানা গেছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের কারণেই জেলা ও মহানগরের সম্মেলন করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ স্থানীয় নেতাদের। এ প্রসঙ্গে মহানগর সভাপতি, সাবেক মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক বলেন, সম্মেলন না করতে পারাটা আমাদের ব্যর্থতা। নতুন কমিটি হলে নেতৃত্ব গতিশীল থাকে। দল সংগঠিত হয়। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনসহ নানা কারণেই সম্মেলন করা হয়নি। দ্রুত সম্মেলন করা হবে। কুষ্টিয়ায় তীব্র কোন্দলে আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও কমিটি দীর্ঘদিন দুই ভাগে বিভক্ত। জেলার সর্বশেষ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ২০০৪ সালের ১৬ এপ্রিল। কোন্দলের কারণে আওয়ামী লীগের জেলা কমিটি ও রাজনীতির মূল সে াতধারার বাইরেও রয়েছে বিদ্রোহী দলীয় আরেকটি শক্তিশালী গ্রুপ। ফলে দলের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত ও শক্তিশালী হওয়ার পরিবর্তে তৃণমূল নেতা-কর্মীরাও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন। যশোর জেলায় ২০০৪ সালের ২১ জানুয়ারি দলের সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আলী রেজা রাজু সভাপতি ও শাহীন চাকলাদারকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি গঠন করা হয়। দীর্ঘদিন সম্মেলন না হওয়ায় ঝিমিয়ে পড়েছে জেলার সাংগঠনিক কার্যক্রম। স্থানীয় নেতারা অভিযোগ করেন, পদ হারানোর ভয়েই দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা সম্মেলন চান না। রাজু সাবেক এমপি। আর শাহীন চাকলাদার উপজেলা চেয়ারম্যান পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। পদ হারানোর ভয়েই তারা নির্বাচন দিচ্ছেন না। এ প্রসঙ্গে জানতে গতকাল সন্ধ্যায় যোগাযোগ করা হলে শাহীন চাকলাদার ফোন রিসিভ করেননি। সভাপতির ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
এগুলো ছাড়াও প্রায় প্রতিটি জেলায়ই আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে হ-য-ব-র-ল অবস্থার মধ্য দিয়ে। অভ্যন্তরীণ কোন্দল উপকোন্দলে রূপ নিয়েছে। ঝিমিয়ে পড়ার কারণে স্থানীয় নির্বাচনেও প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়েছে ক্ষমতাসীন দলটিকে। জেলার নেতারা পদ হারানোর ভয়ে যেমন সম্মেলন করতে আগ্রহী নন, তেমনি কেন্দ্রের নেতাদেরও মধুচন্দ্রিমা কাটছে না।