সাফল্যের চূড়ায়..

0
177
Print Friendly, PDF & Email

তিশার বিশ্বাস ছিল, তিনি মডেলিংয়ের মতো অভিনয়েও ভালো করবেন। তিশা তা পেরেছেন। তার অভিনয় ক্যারিয়ার খুব বেশি দিনের নয়। তার পরও বেশ কয়েকটি ভালো কাজের মাধ্যমে অভিনেত্রী হিসেবে তিশা দর্শকমহলে নিজের আলাদা জায়গা তৈরি করে নিয়েছেন। তাকে নিয়ে লিখেছেন অভি মঈনুদ্দীন

কাজের প্রতি তার আন্তরিকতার কমতি নেই বলে নির্মাতাদের কেউ কেউ মনে করছেন, যেকোনো চরিত্রের জন্য তিশা মানানসই। শিল্পীরা বোধ করি এমনই হন। একবার যে শিল্পের পথ মাড়িয়ে আসেন, সেই পথ আর সহজে মাড়াতে চান না। সব সময়ই তারা চান নতুন পথে হাঁটতে। তবে সবাই যে নতুন পথে নিজের পথচলার ধারাবাহিকতা রাখতে পারেন, তা নয়। এ েেত্র তিশা শতভাগ না হলেও অনেকটাই পেরেছেন। বিশেষ করে ক্যারিয়ারের এই সময়ে এসে তো তিনি আর পেছনে ফিরে যেতে চান না। বৈচিত্র্যময় কাজ দিয়ে তিনি নিজেকে বারবার ছাড়িয়ে যেতে চান। আর কাজ নিয়ে তার এই ভাবনার কারণেই এখন নাট্যকারেরা তিশাকে ভেবে নানা রকম চরিত্র তৈরি করেন। সময়ের আলোচিত এই অভিনেত্রীকে নিয়ে নাট্যকারদের এই আয়োজন সম্পর্কে কী ভাবেন তিশা। শুনুন তার মুখেই, ‘রাইটাররা যদি আমাকে ভেবে কোনো চরিত্র রচনা করেন, তা অবশ্যই আমার জন্য একটি বড় পাওয়া। তবে কোনো কাজের সময় বা তার আগে যদি আমি জানি যে, এই চরিত্রটা আমাকে ভেবেই রচনা কারা হয়েছে, তখন অভিনয়ের প্রতি আমার দায়বদ্ধতা আরো বেড়ে যায়। বিশেষ করে এ ধরনের কাজের সময় আমার চেষ্টা থাকে, নাট্যকারের ভাবনার মতো করে নিজেকে উপস্থাপন করতে।’ বিগত কয়েক দিন তিশার জীবনের ওপর দিয়ে ঝড়ই গেছে বলা চলে। শাশুড়ি মারা যাওয়ার কারণে অনেক দায়দায়িত্ব তার কাঁধে এসে পড়ে। যে কারণে অভিনয় থেকে তাকে কিছু দিন বিরতি নিতে হয়। তবে তিশা আবারো সব ঝামেলা শেষ করে আবারো কাজ শুরু করেছেন। এবার চিত্রনায়ক রিয়াজের বিপরীতে সকাল আহমেদের একটি নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তিশা অভিনয়ে ফিরেছেন। তিশার আজকের অবস্থানের পেছনে আছে অনেক কাঠখড় পোড়ানোর গল্প। আর তার শুরুটা সেই নতুন কুঁড়ি থেকে। অরণ্য আনোয়ারের অতঃপর নূরুল হুদা তিশার অভিনয়জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। তিশার কথায়, নূরুল হুদা অভিনেত্রী হিসেবে আমার টার্নিং পয়েন্ট। আর সিক্সটি নাইন আমার বেইজটা স্ট্রং করে দিয়েছে। নূরুল হুদা দর্শকদের মেসেজ দিয়েছে যে, তিশা বড় হয়েছে। সে এখন নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করতে পারে। আর সিক্সটি নাইন প্রমাণ করেছে যে, তিশা অভিনয় জানে।’ তিশা মনে করেন, অভিনেত্রী হিসেবে তার এই জনপ্রিয়তার নেপথ্য কারিগরদের মধ্যে অন্যতম হলেন অরণ্য আনোয়ার, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও গোলাম সোহরাব দোদুল। তিশার ভাষায়, ‘অরণ্য আনোয়ার, গোলাম সোহরাব দোদুল ভাই ও ফারুকীর কাছে আমি অনেক কৃতজ্ঞ যে, তারা আমাকে বিভিন্ন চরিত্রে কাজের সুযোগ দিয়েছেন। আমাকে নিয়ে তারা এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। আমি যখন অভিনয়ে নতুন ছিলাম, তখন তারা আমাকে নিয়ে কাজ করেছেন বলে আমি বিশেষভাবে তাদের কথা স্মরণ করছি। এ ছাড়াও আরো অনেক পরিচালক রয়েছেন, যারা আমাকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছেন, নানা চরিত্রের মাধ্যমে।’ শুধু মাহফুজ আহমেদ, মীর সাব্বির, চঞ্চল চৌধুরী, মোশাররফ করিম, জাহিদ হাসানের সাথে নয়, তিশা জুটি হয়ে কাজ করেছেন এ টি এম শামসুজ্জামান ও সালাহউদ্দিন লাভলুর মতো শক্তিমান অভিনেতার সাথে। সিনিয়রদের সাথে জুটি হয়ে কাজ করা নিয়ে তিশা বলেন, ‘আমি জুটিপ্রথায় বিশ্বাসী নই। সবার বিপরীতেই কাজ করে আমি মজা পাই। এ টি এম শামসুজ্জামান ও সালাহউদ্দিন লাভলু ভাইয়ের সাথে কাজ করাটা আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। তাদের বিপরীতে কাজ করে আমি অনেক কিছু শিখতে পেরেছি।’ সবাইকে ছাড়িয়ে তিশা তার সমসাময়িক অভিনেত্রীদের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে রয়েছেন। বর্তমানে বিভিন্ন চ্যানেলে চোখ রাখলেই বিষয়টির সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে। নিজের কাজের ধরন নিয়ে তিশা বললেন, ‘এ প্রচারচলতি নাটকগুলোতে আমি ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে কাজ করেছি। যেমন একটি নাটকে আমি গ্রামের বিবাহিত মেয়ের চরিত্রে কাজ করেছি। আবার অন্যটিতে আমাকে দেখা যায়, গ্রামের মেয়েই, কিন্তু অবিবাহিত, একটু ঝগড়াটে। শান্তকুটিরে আমি ফানি, কমেডি ঘরানার একটি চরিত্রে কাজ করেছি। এখানে আমাকে একটু ন্যাকামো করতে দেখা যায়। আবার ৪২০-তে রিয়েলিস্টিক একটি মেয়ে। ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর সে বাস্তববাদী হয়ে ওঠে। সে সব কিছু সুলভ করতে পারে। একজন সাধারণ ঘরের বউ যেমন হয়, সে রকম আর কি। তো আমি লাকি যে, আমার একেকটি সিরিয়াল একেক দিকে হিট করেছে। আসলে আমি কোনো নাটকে কাজের আগে তা নিয়ে অনেক ভাবি। বিশেষ করে কোনো ধারাবাহিকে কাজ করার আগে এর চরিত্র ও গল্প নিয়ে বেশি করে ভাবি। আমার অভিনীত প্রতিটি ধারাবাহিকে কাজ করার আগে ১২-১৩ বার স্ক্রিপ্ট পড়ার পর আমি সিদ্ধান্ত নিই যে, সিরিয়ালটিতে কাজ করব কি করব না।’ মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার চলচ্চিত্র দিয়ে এ মাধ্যমে অভিষেক হয় তিশার। আর প্রথম চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই তিশা চিত্রনায়িকা হিসেবেও ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেন। এই চলচ্চিত্রে কাজের নেপথ্য গল্প নিয়ে তিনি বলেন, ‘কুমিল্লায় রেললাইনের পাশে ব্যাগ নিয়ে বসে আছি আমি। শট নেয়া হবে এমন যে, মেয়েটি একা একা বসে আছে। হঠাৎ করেই ব্যাগ থেকে মুঠোফোন বের করে একটা জায়গায় কল করবে সে। সেফ ডিসটেন্সে ছিলাম বললে ভুল হবে, আবার কিছুটা সেফ ডিসটেন্সে আছিও বলা যায়। অপ্রত্যাশিতভাবে শট রোল দিল। হঠাৎ করে দূর থেকে সবাই ফিল করল যে, ট্রেন আসছে। সাধারণত ওখানকার ট্রেনের গতি খুবই স্লো হয়। কিন্তু আনফরচুনেটলি ওই দিনের ট্রেনটা খুবই স্পিডে ছিল। জাস্ট আমার এক হাত দূর দিয়ে ট্রেনটা গেল। আমি ট্রেনটার দিকে তাকালাম। আমার চোখগুলো পিটপিট করছিল। ব্যাগটা উড়ে যাচ্ছে দেখে হাত দিয়ে তা ধরলাম শক্ত করে। ট্রেনটার দিকে তাকিয়ে আমি ভাবলাম, আচ্ছা আরেকটু হলে কী হতো! ট্রেনটা চলে যাওয়ার পর সবাইকে দেখলাম নিশ্চুপ। তারা আমার কাছে এলেন। বললেন, ঠিক আছো তো তুমি? এটা বলার আগ পর্যন্ত ভালো ছিলাম। যখন তা শুনতে পেলাম, ওই সময় আমি ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে শুরু করলাম। আমার কী যে কান্না পেল! মনে হয়েছিল যেন আমি মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার ছবির শুটিংয়ে এমনই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলাম আমি।’ গ্রামের সহজ-সরল শিতি মেয়ে কোহিনুরকে নিশ্চয়ই ভুলে যাননি অনেকেই। কুসংস্কারে আচ্ছন্ন একটি গ্রামের বাসিন্দা হয়েও তিনি আধুনিক জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখতেন। তথ্যপ্রযুক্তির খোলা জানালা যেখানে সচেতনভাবে বন্ধ করে রাখা হয়েছে, সেখানে স্রোতের বিপরীতে গিয়ে কম্পিউটার, ইন্টারনেট মোবাইল ফোন ব্যবহারের প্রতি তার অদম্য আগ্রহ দেখা গেছে। পাশাপাশি টেলিভিশনের প্রতিও তার প্রবল ঝোঁক। সেই কোহিনুর হঠাৎ করেই গ্রাম থেকে গ্রামান্তর, শহর কিংবা দেশ পেরিয়ে বিদেশেও পরিচিত হয়ে উঠেছেন। চার দিকে তার সরব উপস্থিতি। প্রশংসাও কুড়িয়েছেন আশাতীত। গ্রামের তথ্যপ্রযুক্তির ঝোঁকে অনুরক্ত কোহিনুরের কর্মকাণ্ড মনে ধরেছে দেশ পেরিয়ে বিদেশেও। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত টেলিভিশন ছবির নায়িকা কোহিনুর ছিল এমনই। নুসরাত ইমরোজ তিশা পর্দায় ও বাস্তবজীবনে কোহিনুর চরিত্রে অভিনয়ের জন্য সাফল্যের ঝুলি পূর্ণ করে চলেছেন একাদিক্রমে। ঘটনার শুরুটা ছিল বাংলাদেশের দর্শকের কাছ থেকে। আর সেটার চূড়ান্ত পূর্ণতা পায় দণি কোরিয়ার বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। গত বছরের অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত এ উৎসবে টেলিভিশন ছবিটি প্রদর্শিত হয়। সেখানকার দর্শকের মন ভরাতে সম হয়েছিল ছবিটি। পাশাপাশি পরিচালক ফারুকীর সাথে তিশাও সশরীরে উপস্থিত হয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন দণি কোরিয়ার অসংখ্য সিনেপ্রেমী দর্শকের। এর পরের গল্পটা কিন্তু একেবারেই থেমে যায়নি। একের পর এক চমক আর মন ভালো করে দেয়া খবরে তিশার বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে। দণি কোরিয়ার উৎসব শেষে তিশা হয়তো ভুলেই গিয়েছিলেন সেখানকার সিনেপ্রেমী মানুষের কথা। কিন্তু তারা তিশা এবং তার অভিনয়কে একসাথেই রেখে দিয়েছেন স্মৃতির অ্যালবামে। সে কথা গুরুত্বের সাথে উপলব্ধিতে এসেছে দেশটির সরকারের। জনগণের পছন্দের অভিনেত্রীকে তারা এবার সম্মান জানালেন অন্যমাত্রায়। এ মাসের শুরুতে দণি কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তিশাকে দুই বছরের জন্য সাংস্কৃতিক দূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। এর পরিপ্রেেিত তিশাও অনেকখানি খুশি হয়েছেন। এটা তার অভিব্যক্তিতেই ফুটে উঠল। তিশা বলেন, ‘যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি হয়ে গেল। আমি তো এত কিছু আশা করিনি। তবে আমাকে যে সম্মান জানাল, তা শুধু আমার জন্য নয়, দেশের জন্যও সম্মান বয়ে আনল। আমাকে যে দায়িত্ব দেয়া হলো, তা আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধের মধ্য দিয়ে পালন করতে চাই।’ এ কথা বলার পর কিছুটা আনমনা মনে হলো তিশাকে। হঠাৎ করেই আবার ফিরে গেলেন গত বছরের অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত বুসান উৎসবে। তিশা বলেন, ‘আমি এবং সরয়ার বেশ কয়েক দিন ছিলাম সে সময় দণি কোরিয়ায়। আমাদের ছবিটি প্রদর্শনের পর যেখানেই গিয়েছি সেখানেই মানুষের আগ্রহ ল করেছি আমাদের ঘিরে। সেখানকার সংবাদপত্রগুলোও আমাদের ছবি ও সংবাদ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে। আয়োজক থেকে শুরু করে সাধারণ দর্শকের সহজভাবে আমাদের গ্রহণ করাটা বেশ আনন্দ দিয়েছে।’ তিশার এমন সাফল্যে আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকেও প্রশংসা আর শুভকামনা পাচ্ছেন অনবরত। অনেকেই বলে থাকেন, সাফল্য যখন আসতে থাকে তখন নাকি কেউ তা রোধ করতে পারে না। এমন আরেকটি ঘটনা ঘটল এ মাসেই। বাংলাদেশ থেকে একটি মাত্র ছবি অস্কার পুরস্কারে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য মনোনীত হয়েছে। আর এটাও সেই টেলিভিশন। এবার বিশ্বের মর্যাদাপূর্ণ এ আসরে বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বরাও তিশার অভিনয়ে চোখ বুলাবেন। এমন সব খবরে তিশা বেশ ফুরফুরে মেজাজেই আছেন। তিনি বলেন, ‘আমার কাজ ছিল আমার চরিত্রটিকে ঠিকমতো উপস্থাপন। সেটাই আমি ঠিকমতো করার চেষ্টা করেছি। মূল্যায়ন কিংবা স্বীকৃতি যদি এর জন্য আসে তাহলে তো ভালো লাগবেই। তবে অস্কার পুরস্কারের আমার অভিনীত ছবি প্রদর্শিত হবে। এটা অনেক বড় অর্জন আমার ক্যারিয়ারে।’ তবে এত সব আয়োজন ও ঘটনার মধ্য দিয়ে নিজেকে নিয়ে গেলেও একটি কাজকে কিন্তু একটুও ভোলেননি কিংবা অবহেলা করেননি। তা হলো ছোটপর্দা, নাটকে অভিনয়। সাফল্যও উদযাপন করছেন। সেই সাথে কাজও করছেন। প্রচারচলতি ধারাবাহিক কয়েকটিতে সময় দেয়ার পাশিপাশি ঈদের নাটকেও কাজ করে হয়েছেন আলোচিত। কিছু বিশেষ অনুষ্ঠানেও তাকে দেখা যায় তাকে। তা ছাড়া তার ক্যারিয়ারের তৃতীয় ছবির কাজও অনেকটাই শেষ। যথারীতি এ ছবির পরিচালনায়ও মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। অল্প সময়ের মিডিয়া জার্নিতে এত সব অর্জনও তিশার পরিকল্পনায় ছেদ ঘটাবে না বলে জানালেন তিনি। তার মতে, ‘আমি যেমন ছিলাম, তেমনই থাকব। তবে অভিনয়ের জায়গাটায় শুধু পরিবর্তন আনব।’ সাফল্যের ট্রেন তিশাকে কোন স্টেশনে পৌঁছায়Ñ সেটাই দেখার প্রত্যাশায় রয়েছেন তিশার ভক্তরা।

শেয়ার করুন