সহিংস রাজনীতিতে অর্থনীতির ক্ষতি ১১ হাজার কোটি টাকা

0
169
Print Friendly, PDF & Email

বিগত সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে তা ১৪০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ বলে হিসেব করেছে বিশ্বব্যাংক। টাকার অংকে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের শুরুতে ২০১৩ সালের জুলাই থেকে গত জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ৪৫ দিন দেশে উত্পাদন কাজ বন্ধ ছিলো। সহিংসতায় শুধু যাতায়াত কিম্বা শিল্পখাতই নয়, দেশের অনেক স্কুল, কলেজসহ বিভিন্ন অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেবাখাত, যা ক্ষয়ক্ষতির ৮৬ শতাংশ, এর পরে শিল্পখাতে ১১ শতাংশ এবং কৃষিখাতে ৩ শতাংশ। আর এ কারণে অর্থবছর শেষে প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে আসবে বলে মনে করছে সংস্থাটি।

গতকাল বুধবার বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের হালনাগাদ উন্নয়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ঢাকা অফিসের শীর্ষ অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসাইন মূল প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন। ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর ক্রিস্টিনা ই. কিমসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও অর্থনীতিবিদরা এসময় উপস্থিত ছিলেন।

উল্লেখ্য, এর আগে জানুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) হিসেব করে জানিয়েছিল, ছয় মাসে দেশের সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অর্থনীতির বড় ৪ খাতে যে ক্ষতি হয়েছে তার পরিমাণ টাকার অংকে ৪৯ হাজার ১৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা। যা মোট দেশজ আয়ের (জিডিপি) ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের হিসেবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা।

হিসেবে এত বড় পার্থক্যের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে জাহিদ হোসাইন বলেন, বিশ্বব্যাংকের হিসাবে উত্পাদনের ক্ষতির বিষয়টি উঠে এসেছে। যথাসম্ভব দ্বৈততার বিষয়টি পরিহারের চেষ্টা করা হয়েছে। অনেকেই ক্ষয়-ক্ষতির হিসাবে একই বিষয়কে কয়েকবার গণনার মধ্যে নিয়ে আসায় টাকার হিসাবে বড় হয়ে পড়েছে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের যে সম্ভাবনা রয়েছে তাতে খুব সহজেই সাড়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব। এর জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাসহ অবকাঠামো খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করতে হবে।

সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রয়েছে। প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে ক্ষমতা রয়েছে প্রকৃত অর্জন তার চেয়ে অনেক কম হয়েছে। চলতি অর্থবছরের শুরুতে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, তৈরি পোশাক শিল্পের ইমেজ সংকট এবং আর্থিক খাতে চাপ থাকলেও সম্প্রতি নতুন করে যুক্ত হয়েছে রেমিটেন্সের নিম্নগতি এবং রাজনৈতিক সংকট থেকে সৃষ্টি হওয়া ক্ষয়ক্ষতি। ডলারের তুলনায় টাকার মূল্যমান স্থিতিশীল রয়েছে। মূল্যস্ফীতির পরিমাণ এক অংকের ঘরে থাকলেও তা বাংলাদেশের সমকক্ষ অর্থনীতির দেশগুলোর তুলনায় বেশি। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। বিশ্ববাজারে আমাদের প্রতিযোগী-সক্ষমতা তুলনামূলক কমেছে। দুর্বল আমদানির প্রভাবে বৈদেশিক বাণিজ্যের উদ্বৃত্ত লক্ষ্য করা গেছে।

বিগত রাজনৈতিক সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় ব্যবসায়ীদের যে ব্যাংক ঋণ দেয়া হয়েছে তা পরিশোধে অনিশ্চয়তা রয়েছে। ফলে আর্থিক খাতে ঝুঁকিগুলো কমে আসার যে প্রত্যাশা করা হয়েছিলো তা হয়নি। অন্যদিকে মন্দের ভালো হিসাবে, সরকারের ভর্তুকি এবার কম হবে। এর কারণ হলো রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে পরিবহন ব্যবসা অনেকদিন বন্ধ ছিলো। পরিবহনে ডিজেলের ব্যবহার হরাস পাওয়ার ফলে এ খাতে সরকারের ভর্তুকি কিছুটা হলেও কম হবে। সবমিলিয়ে সরকারের ভর্তুকি তার লক্ষ্যমাত্রার আশেপাশেই থাকবে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে সাড়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পরিবহন, বিদ্যুত্খাতে চলমান অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোতে বিশেষ নজর দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এর সাথে রেমিটেন্স বৃদ্ধি করতে প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তাসহ তৈরি পোশাক শিল্পে ইমেজ সংকট কাটাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। অর্থনীতির সম্ভাবনাগুলো বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরবর্তী বছরগুলোতে প্রবৃদ্ধি পুনরায় ৬ শতাংশের উপরে উঠে আসবে।

বিদ্যুত্ খাত:

অর্থনীতির হালনাগাদ তথ্যে এবার বিদ্যুত্ খাতের সম্প্রসারিত বিশ্লেষণ করেছে বিশ্বব্যাংক। প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, বিদ্যুত্ খাতে সক্ষমতা সূচকে ১৪৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৩তম। উত্পাদন বৃদ্ধির পরেও পিক-আওয়ারে বিদ্যুতের প্রায় ৩০ শতাংশ ঘাটতি রয়েছে। ৬০ শতাংশ উত্পাদনকারী নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ডিজেলের মাধ্যমে বিদ্যুতের প্রয়োজন মেটাচ্ছে। বর্তামানে ২৫ শতাংশ বিদ্যুত্ উত্পাদন হচ্ছে পুরোনো কেন্দ্রগুলো থেকে, ফলে অপচয়ও বেশি হচ্ছে। অদক্ষ ব্যবস্থাপনার ফলে লোডশেডিং হচ্ছে। গ্যাসের সংকটে বর্তামানে ৫০০ মেগাওয়াট উত্পাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুকেন্দ্র অলস পড়ে আছে। যার ফলে শিল্প উত্পাদনসহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে। ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হিসাবে প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে কিন্তু সে পরিমাণ বিনিয়োগ হচ্ছে না।

গত নভেম্বরে অর্থনীতির হালনাগাদ প্রতিবেদনে প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৭ শতাংশ হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে এসে এটি আরো কমিয়ে ফেললো সংস্থাটি। তবে সার্বিক বিবেচনায় ৫ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধিকে সন্তোষজনক উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। সমপ্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) তাদের পূর্বাভাসে প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসবে বলে উল্লেখ করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, প্রবৃদ্ধি নেমে আসবে ৬ শতাংশের নিচে।

শেয়ার করুন