ইসির লোকদেখানো নাটক

0
109
Print Friendly, PDF & Email

উপজেলা নির্বাচনে যখন কারচুপি, ব্যালট বাঙ্ ছিনতাই, কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট দেয়ার ঘটনা ঘটছিল, তখন পুরোমাত্রায় নিষ্ক্রিয় ছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রথম দুই ধাপে অল্পসংখ্যক এলাকায় ভোট ডাকাতি, সহিংসতা হলেও ইসির নীরব ভূমিকার কারণে পরের ধাপগুলোতে তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। চরম সহিংসতার মধ্যে পাঁচ ধাপের নির্বাচন শেষে এখন ‘উদোর পি-ি বুধোর ঘাড়ে’ চাপানোর কৌশল নিয়ে মাঠে নেমেছে ইসি। অথচ দফায় দফায় নির্বাচনের সময় কারচুপি যখন বেড়েই চলছিল, তখন সংবাদ মাধ্যমে সব তথ্য তুলে ধরা হয়। তখন ইসির পক্ষ থেকে বরং সাফাই গাওয়া হয়। নির্বাচনে কিছু সহিংসতা হয়, এমনও বলা হয়। এখন নির্বাচন শেষ, গেজেট প্রকাশ হয়েছে, শপথও প্রায় শেষ; আর এ পর্যায়ে ইসি নেমেছে তদন্তে। অভিজ্ঞমহলের মতে এটি স্রেফ ইসির লোকদেখানো নাটক।

এরই অংশ হিসেবে চলতি সপ্তাহে একজন নির্বাচন কমিশনার সাংবাদিকদের জানান, মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবহেলার কারণে নির্বাচনে ভোট ডাকাতি আর সহিংসতা রোধ করা সম্ভব হয়নি। ওই কমিশনারের মন্তব্যের পরই নির্বাচনে সংঘটিত অনিয়মের সত্যতা খোঁজার লক্ষ্যে মাঠে নামার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ইসি। এ অনুযায়ী ইসি এরই মধ্যে বিভিন্ন উপজেলায় ভোট জালিয়াতির বিষয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত ৭০টিরও বেশি প্রতিবেদন উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে তদন্ত রিপোর্ট পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের ধারণা দেয়া হয়েছে, প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্যের সেসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ মিললে তাদের চাকরি থেকে বরখাস্তসহ কঠোর শাস্তি দেয়া হবে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত কাজ সম্পন্ন করে রিপোর্ট পাঠাতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয় শাখা-২ এর সহকারী সচিব আশফাকুর রহমান আলোকিত বাংলাদেশকে জানান, উপজেলা নির্বাচনের সময় পত্রিকায় ভোটের অনিয়মের সংবাদ এসেছে। এসব প্রতিবেদনের বিষয়ে তদন্ত করার জন্য প্রশাসন ও পুলিশকে নির্দেশনা দিয়েছে ইসি। সহিংসতা ও ভোট জালিয়াতির বিষয়ে পত্রিকার প্রতিবেদনের বিষয়টি উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও রিটার্নিং কর্মকর্তাকে তিন সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত করে জানানোর জন্য চিঠি পাঠানো হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার মোঃ শাহ নেওয়াজ বলেন, প্রথম থেকে পঞ্চম ধাপ পর্যন্ত ৪৫৮ উপজেলায় নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। দেখা গেছে, কিছু কিছু উপজেলায় নির্বাচনী সহিংসতা, ব্যালট পেপার ও বাঙ্ ছিনতাই এবং জালভোটের অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। আমরা সেসব অভিযোগ একত্রিত করে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার জন্য রিটার্নিং অফিসার ও ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনী অনিয়ম করে যাতে কেউ পার না পান, তার জন্য ‘বিজয়ী প্রার্থীদের গেজেট ছাপানোর আগে’ ফল বাতিলের ক্ষমতা চাওয়া হবে সরকারের কাছে।

এর আগে সিইসির অনুপস্থিতিতে রুটিন দায়িত্বে থাকা নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মোবারক বলেন, কোনো অভিযোগ তামাদি হয় না। যারা অনিয়ম করে মনে করছেন নির্বাচন শেষ হওয়ায় পার পেয়ে যাবেন, আমি দায়িত্বে থাকাকালে তারা সে সুযোগ পাবেন না। তিনি বলেন, আমি কোনো অনিয়মকে বরদাশত করব না। তিনি বলেন, সদ্যসমাপ্ত উপজেলা নির্বাচনের বিভিন্ন অনিয়ম বিভিন্ন পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে প্রকাশিত তথ্য ও ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করেছি। এর আলোকে তদন্ত করে অভিযুক্তদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। ইসি কর্মকর্তারা জানান, উপজেলায় যেসব অনিয়মের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন তদন্ত শুরু করেছে, সেগুলোর মধ্যে টাঙ্গাইলের একটি নির্বাচনে ভোটগ্রহণের দায়িত্বে থাকা পোলিং অফিসারের মন্তব্য ছিল এ রকম, ‘ভাই আমরা জিম্মি, নো কমেন্টস।’ শাহজাদপুরে একজন প্রার্থীর মন্তব্য, ‘আমি প্রার্থী, আমি নিজেই ভোট দিতে পারলাম না।’ লক্ষ্মীপুরে একটি উপজেলায় ভোটারদের উদ্দেশ্যে দখলকারীদের মন্তব্য, ‘বাড়ি যান ভাই, আমরা ভোট দিয়ে দেব।’ আরেকটি উপজেলায় গণমাধ্যমকে প্রকাশ্যে হুমকির মন্তব্যটি ছিল, ‘ক্যামেরা বন্ধ, নইলে কোপ।’ প্রিসাইডিং অফিসারের উদ্দেশে সশস্ত্র সন্ত্রাসীর মন্তব্য, ‘টাকা নিয়ে চলে যান, আমরাই সবকিছু করব।’ এছাড়া পত্রিকার কিছু শিরোনাম ছিল_ সিরাজগঞ্জে ২৫ কেন্দ্রে ভোট কারচুপি, শাহজাদপুরে হরতাল, গফরগাঁওয়ে পোলিং অফিসারকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া, পুলিশের বিরুদ্ধে ভোট ডাকাতি, শ্রীপুরে দিনভর জাল ভোট, অষ্টগ্রামে এমপির নেতৃত্বে ৩৫ কেন্দ্রে ভোট ডাকাতি, কুমিল্লায় গুলি, রাতে বাড়ি বাড়ি হুমকি, জাল ভোটে টাঙ্গাইলে ভোটগ্রহণ এবং সাতক্ষীরায় ওসির দাপটে ভোটারশূন্য কেন্দ্র। নির্বাচনী তদন্তে সেসব অভিযোগের সত্যতা পেলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, প্রার্থী কিংবা তার কর্মী-সমর্থকরা বা অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে বলে ইসির সিনিয়র কর্মকর্তারা জানান।

১৯৯১ সালের নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) ১৩নং আইনের ৫-এর (১)-এ বলা আছে, ‘কোনো নির্বাচন কর্মকর্তা নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো ব্যাপারে প্রদত্ত কমিশন বা রিটার্নিং অফিসারের কোনো আদেশ বা নির্দেশ পালনে ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যর্থ হলে বা অস্বীকৃতি প্রকাশ করলে বা নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো আইনের বিধান ইচ্ছাকৃতভাবে লঙ্ঘন করলে বা কোনো অপরাধ করলে তিনি অসদাচরণ করেছেন বলে গণ্য হবে। এমন অসদাচরণ তার চাকরিবিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। (২)-এর উপধারা (১)-এ বলা আছে, অসদাচরণ করলে তার নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরি থেকে অপসারণ বা বরখাস্ত করতে পারবে বা বাধ্যতামূলক অবসর দিতে পারবে বা তার পদাবনতি করতে পারবে বা তার পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধি দুই বছরের জন্য স্থগিত রাখতে পারবে। (৩) ধারা অনুযায়ী দুই মাসের জন্য সাময়িকভাবে চাকরি থেকে বরখাস্তের আদেশ দিতে পারবে। আইনের ৬ ধারার (১) উপধারায় বলা হয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তি সর্বোচ্চ এক বছর কারাদ-ে বা সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয়বিধ দন্ডনীয় হবেন। ৫(৩)-এর অধীন প্রদত্ত কোনো আদেশ পালন বা কার্যকর না করলে বা ধারা ৫(৪)-এর বিধান লঙ্ঘন করলে তিনি সর্বোচ্চ ছয় মাস কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডনীয় হবেন। কমিশন থেকে সাধারণ বা বিশেষভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তির লিখিত অভিযোগ ছাড়া কোনো আদালত এ আইনের অধীন কোনো অপরাধ বিচারের জন্য গ্রহণ করতে পারবেন না।’

শেয়ার করুন