শুল্কমুক্ত গাড়ির অপেক্ষায় নতুন সাংসদরা

0
134
Print Friendly, PDF & Email

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন ১৫৪ জন। বাকিরা নির্বাচিত হয়েছেন ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচনে। নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে ভোটারদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাত করাতো দূরের কথা রাজধানী কেন্দ্রিক রাজনীতির খোলস থেকে বের হতে পারেননি নতুন ৩’শ সাংসদ। এর পাশাপাশি নির্বাচিত হয়েছেন সংরক্ষিত নারী আসনে ৪৮ জন। ২ জন বাকি আছে। এদের সবাই এখন শুল্কমুক্ত গাড়ি চান। এরপর রাজউকের প্লট থেকে শুরু করে ন্যাম ফ্ল্যাট বা যাবতীয় যত সুবিধা নেয়া যায় তা থেকে পিছপা হবেন না তারা। সংসদ কার্যকর হোক না হোক, কোরাম পূর্ণ হোক না হোক তারা তাদের প্রাপ্য সুবিধা একেবারে উসুল করে নেবেন। তাদের আগে যারা সাংসদ হয়ে এসেছেন তারাও তা নিয়েছেন।

শুধু শুল্কমুক্ত গাড়ি দিতে রাষ্ট্রের রাজস্ব গচ্চা দিতে হবে অšত্মত ৩ হাজার কোটি টাকা। এর আগে সংসদ নির্বাচনের পর যথারীতি সাংসদরা শুল্কমুক্ত গাড়ি কেনার জন্যে আবেদন দিয়েছেন। গাড়ি কিনেছেন। অনেকে শুল্কমুক্ত গাড়ি ক্রয়ে ছাড়পত্র পেয়ে তা বাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন এমন অভিযোগও উঠেছে।

এবারো শুল্কমুক্ত গাড়ি কেনার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন দশম জাতীয় সংসদের এমপিরা। নাম সবর্স্ব বিরোধী দল নিয়ে গঠিত সংসদ বেশি দিন টিকবে না এমন আশঙ্কায় আগেভাগেই শুল্কমুক্ত গাড়ি পাওয়ার জন্য আবেদনের হিড়িক পড়েছে সংসদ সচিবালয়ে। দশম সংসদ গঠনের মাত্র তিন মাসের মাথায় আবেদন পড়েছে অনেক। কিন্তু এ দাবি পূরণ করতে হলে সরকারকে রাজস্ব হারাতে হবে অšত্মত ৩ হাজার কোটি টাকা।

গত ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে দেশের অন্যতম রাজনৈতিক বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট অংশ নেয়নি। ফলে নিজেদের শরিকদের নিয়ে একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। ভোট ছাড়াই ১৫৪ জন এমপি নির্বাচিত হন। পরে ১৪৭টি আসনে ভোটগ্রহণ হলেও ব্যাপক অনিয়ম ও ভোটার উপস্থিতি না থাকায় দেশ-বিদেশে ওই নির্বাচন ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়। ফলে সংসদ গঠনে একটু কৌশলের আশ্রয় নেয় আওয়ামী লীগ। যেহেতু বিরোধী দলবিহীন সংসদ গঠন করা সম্ভব নয় তাই নিজেদের শরিক দল জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল ও সরকারি দল উভয়পক্ষে রেখে একটি সংসদ গঠন করে।

আর এই সংসদের মেয়াদ বেশি দিন স্থায়ী হবে না ভেবে সরকারের যাত্রা শুরুর অল্প কিছুদিন পর থেকেই এমপিরা ফায়দা হাসিলের সুযোগে ব্য¯ত্ম হয়ে পড়েন। এরই অংশ হিসেবে শুল্কমুক্ত গাড়ির জন্য আবেদন করতে থাকেন। এমপিরা দায়িত্ব নেয়ার মাত্র দুই মাসের মাথায় শতাধিক আবেদন পড়ে সংসদ সচিবালয়ে।

শুল্কমুক্ত কোটায় পাঁচ কোটি টাকা বাজার মূল্যের গাড়ি মাত্র ৬৫ লাখ টাকায় পেয়ে যান এমপিরা। আর তাতে এবার দশম সংসদে সরকারের ক্ষতির পরিমান কয়েক হাজার কোটি টাকা হবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

নবম সংসদে শুল্ক গাড়ি আমদানির সুবিধা নিয়েছিলেন ৩১৫ জন এমপি। আর তাতে সরকার বঞ্চিত হয়েছিল ১ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা থেকে। অষ্টম সংসদে ২০০৪ সাল থেকে ২০০৭ পর্যন্ত ১৩৫ জন সংসদ সদস্য এই সুবিধা নেন। তাতে সরকার বঞ্চিত হয়েছিল ৫৪৭ কোটি টাকা থেকো। অন্যদিকে সপ্তম জাতীয় সংসদে এই রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ ছিল পৌনে ২০০ কোটি টাকা।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের বাজেট এখনও দাতা সংস্থার অর্থের আশ্বাসের ওপর নির্ভর করে তৈরি হয়। তাই জনপ্রতিনিধিদের নিজেদের স্বার্থে এমন কাজ করা উচিত নয়, যাতে সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়।

এদিকে ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসে সংসদ সদস্যদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুবিধা বাতিল করে। গতবার মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথমে সংসদ সদস্যদের জন্যে শুল্কমুক্ত গাড়ির সুবিধা রাখা হবে না বলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সিদ্ধান্ত বহাল রাখা হলেও শেষ পর্যন্ত এমপিদের চাপে সিদ্ধান্ত বদলাতে হয়। আর এবার এরই মধ্যে অনেক সংসদ সদস্য গাড়ি আমদানির জন্যে আবেদনের নমুনা ফরমও সংগ্রহ করেছেন। তবে বিশেষ এ সুবিধার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এখন এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।

এ ব্যাপারে সংসদ সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) সুলতান মাহমুদ জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরই সংসদ সচিবালয় থেকে প্রস্তাবনা পাঠানো হবে।

এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত না হলেও নতুন সদস্যদের অনেকেই এ সুবিধা গ্রহণের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণছেন। তাদের কেউ কেউ ব্যক্তিগত সহকারির মাধ্যমে সংসদ সচিবালয়ের সেবা শাখা থেকে আগের আবেদনের নমুনা ফরম সংগ্রহ করেছেন। এর সংখ্যা শতাধিক। এটি নিশ্চিত করেছেন সংসদ সচিবালয়ের একজন সিনিয়র সহকারি সচিব (সেবা)।

জানা গেছে, এবার শুল্কমুক্ত কোটায় গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে কিছু শর্ত দেওয়া হবে। শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা গাড়ির হাতবদল ও অন্যান্য অনিয়ম ঠেকাতে কিছু শর্ত জাতীয় সংসদ সচিবালয় পাঠিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এমপিরা বিনাশুল্কে গাড়ি এনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা বিক্রি করে দেন। অত্যাধুনিক বুলেটপ্রুফ গাড়িসহ এমপিরা এ পর্যন্ত ১৩ শতাধিক বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করেছেন।

বিনাশুল্কে আনা এসব গাড়ির ৮০ শতাংশই হাতবদল হয়েছে। দেশে আমদানিকৃত প্রতিটি গাড়ি গড়ে দেড় থেকে তিন কোটি টাকায় হাতবদল হয়। আর এগুলো কিনে নেন একশ্রেণির ব্যবসায়ীরা। তাতে তাদেরও কোটি টাকার ওপরে লাভ হয়। সে কারণে গাড়ি আমদানির জন্য সংসদ সদস্যদের পেছনে টাকাও ঢালেন তারা। আর মাঝখান থেকে বঞ্চিত হয় সরকার ও জনগণ।

পার্শ্ববর্তী ভারতের এমপিরা সরকারি নিয়মে ব্যবহার করেন ১৩০০ সিসির গাড়ি। সেখানে বাংলাদেশের এমপিরা গড়ে ব্যবহার করছেন ৩০০০ সিসি থেকে সাড়ে ৫ হাজার সিসির বিলাসবহুল গাড়ি।

এমপিরা গাড়ি আমদানি করলেও নিয়মের বাধ্যবাধকতার কারণে চার বছর আগে তা বিক্রি করতে পারেন না। সে কারণে চার বছর গাড়ির কাগজপত্র সব এমপির নামেই থাকে। কিন্তু তা ব্যবহার করেন টাকা ঢালা ওই ব্যবসায়ী। আর এমপি চড়েন তুলনামূলক কম দামের গাড়িতে।

এমপিদের জন্য শুল্কসহ যাবতীয় করমুক্ত গাড়ি আমদানির প্রথম সুযোগ দেন সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৮ সালে। পরে ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ, ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ সংসদ (১৫ ফেব্র“য়ারির) ও সপ্তম সংসদ এবং ২০০১ সালের অষ্টম সংসদে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত এমপিরা একটি করে জিপ বা কার শুল্ক ও যাবতীয় করমুক্তভাবে আমদানি করেন।

তখনকার সার্কুলারে মাত্র একবার শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির বিধান থাকায় একাধিকবার নির্বাচিতরা নতুন করে আমদানির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। পরে ২০০২ সালের ২৮ আগস্ট এ সার্কুলার সংশোধন করা হয়। সংশোধিত সার্কুলার অনুযায়ী কোনো সংসদ সদস্য একাধিকবার নির্বাচিত হলে প্রথমবার সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণের তারিখ থেকে ৮ বছর পর কিংবা তার পর যে কোনো সময় সংসদ সদস্য থাকাকালীন তিনি আমদানি শুল্ক, ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্কসহ যাবতীয় করমুক্তভাবে আরো একটি জিপ বা কার আমদানি করতে পারবেন। আর এই সুযোগে বারবার নির্বাচিতরা রীতিমতো গাড়ি কেনার উৎসবে মেতেছেন।

শেয়ার করুন