ছাত্রনেতা সাদ হত্যার পর বেরিয়ে আসছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নামধারীদের তাণ্ডবের লোমহর্ষক নানা কাহিনী। ছাত্রদের ৯টি আবাসিক হলের অতিথি কক্ষ টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করছে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। এদের বিরুদ্ধে কিছু বললে টর্চার সেলে ধরে এনে রাতভর নির্যাতন চালানো হয়।
ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এই প্রথম নয়। দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ, ছাত্রলীগ কর্মীরা শিক্ষার্থীদের ওপর নানাভাবে নির্যাতন চালায়। আবাসিক হলের এই নির্যাতন কেন্দ্র নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাওয়া যায়না।
প্রতিটি আবাসিক হলেই আছে এমন গেস্ট রুম। সাধারণ শিক্ষার্থীদের আত্মীয় স্বজন বা দর্শনার্থীদের জন্য এসব রুম। কিন্তু শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এসব রুম ব্যবহার হয় প্রতিপক্ষ ছাত্রদের নির্যাতনের কাজে। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের এখানে নিয়মিত মারধর করার অভিযোগ রয়েছে। ক্যাম্পাস বা হল থেকে বের করে দেয়ার আতংকে অথবা শারীরিক নির্যাতনের ভয়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এখন আর কেউ প্রকাশ্য মুখ খুলতে চায় না।
প্রতি রাতে এখানে ছাত্রলীগের নেতাদের সামনে হাজিরা দিতে হয় সাধারণ ছাত্রদের। তাদের ওপর চলে মানসিক নির্যাতন।
গেস্টরুমে সাধারণ ছাত্রদের নিয়মিত হাজিরা দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও। প্রতিদিন রাত ৯টার পর হলের অতিথি কক্ষে ছাত্রলীগ নেতাদের সামনে প্রথম বর্ষ তথা জুনিয়র শিক্ষার্থীদের হাজিরা দেয়া প্রায় বাধ্যতামূলক। আর এটাই ছাত্রলীগ নেতাদের অঘোষিত নিয়ম। ব্যত্যয় হলেই চলে আবাসিক শিক্ষার্থীদের ওপর নানা নির্যাতন।
ছাত্রদলের সিনিয়র সহসভাপতি রুহুল আমিনসহ একাধিক নেতাকর্মী অভিযোগ করে বলেন, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনোমালিন্য বা কথাকাটাকাটি হলেই তাদের ওপর অত্যাচার চালানো হয়। ছাত্রদল বা শিবিরের ধুয়া তুলে তাদের অতিথি কক্ষে মারধর করা হয়। এ ছাড়া ক্যাম্পাসে ছাত্রদল বা ছাত্রশিবিরের কোনো নেতাকর্মীর উপস্থিতি বুঝতে পারলে ছাত্রলীগ লাঠিসোটা, রড, ছুরি, হকিস্টিক নিয়ে তাদের ওপর হামলা চালান হয়। বেধড়ক পিটিয়ে বা কখনও ধরে এনে বন্দি করে রাখা হয় হলের অতিথি কক্ষে। রাতভর চালানো হয় নির্যাতন।
ছাত্রদলের নেতারা আরও জানান, ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কোনো সংগঠনের নাম মুখে আনা বারণ। প্রতিদিন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে নেতাদের পিছু নিয়ে ছুটতে হয় শোডাউনে। লেডিস হলের সামনে দাঁড়িয়ে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করা ছাত্রলীগ কর্মীদের নিত্যদিনের কাজ। ক্যাম্পাসের কেআর মার্কেটে গিয়ে শীর্ষ নেতাদের ঘিরে শুনতে হয় তাদের দীক্ষা।
নির্যাতনের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না বলে সাধারণ ছাত্রদের অভিযোগ।
তবে এবিষয়টি অস্বিকার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা প্রফেসর ড. সুলতান উদ্দিন ভূইয়া বলেন, “র্যাতনের ব্যাপারে আমরা কোনো অভিযোগ পায়নি। কেউ অভিযোগ করলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকটি আবাসিক হলের শিক্ষার্থীরা জানায়, হলের পরিবেশ নষ্ট করছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাই। ব্যক্তিগত ক্ষোভ মেটাতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নামে শিবিরের ধুয়া তুলে চালানো হয় শারীরিক নির্যাতন। হলে ছাত্রলীগের দাপটে তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে পারে না। অন্যদিকে প্রভোস্ট ওই সব নেতাকর্মীর কথামতো চলেন।
এদিকে ক্যাম্পাসে সাদ হত্যার বিচার দাবিতে যেন কোনো ধরনের বিক্ষোভ-সমাবেশ না হয় এবং তাতে যেন কোনো ছাত্র অংশগ্রহণ না করে সে বিষয়ে আবাসিক হলের ছাত্রদের বিভিন্ন হুমকি-ধমকি দিচ্ছে ছাত্রলীগ। বৃহস্পতিবার ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হলের গেস্টরুমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ডেকে ছাত্রলীগের ব্যানার ছাড়া অন্য কোনো ব্যানারে মিটিং মিছিল করতে নিষেধ করে দিয়েছে।
আর এদিকে এ বিষয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি মুর্শেদুজ্জামান খান বাবু বলেন, বর্তমান ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছে। ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কোনো রকম খারাপ আচরণ পর্যন্ত করে না, শারীরিক নির্যাতন তো দূরের কথা। ক্যাম্পাসে ছাত্রদল-শিবির সবাই লেখাপড়া করার সমান সুযোগ পায়। এ অভিযোগ ছাত্রলীগের সম্মানহানি করার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
উল্লেখ্য গত এক দশকে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত ১৫ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন ঘটনায় নিহত হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত একটি হত্যাকান্ডেরও বিচার হয়নি।